শোকার্ত পরিজন। রবিবার। নিজস্ব চিত্র ।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই বোনের মৃত্যুর ঘটনায় পরিকল্পনা করে খুনের অভিযোগ উঠল বাবার বিরুদ্ধে। স্বামীর ‘বিবাহ-বহির্ভূত’ সম্পর্কের জেরে পরিকল্পনা করে মেয়েদের খুন করা হয়েছে বলে রায়না থানায় অভিযোগ করলেন দুই নাবালিকার মা শিউলি বেগম। রবিবার দুপুরে স্বামী হাসিবুল লায়েক, শাশুড়ি হুসনিহারা বিবি-সহ তিন জনের বিরুদ্ধে রায়না থানায় অভিযোগ করেছেন তিনি। হাসিবুলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
শনিবার বিকেল ৫টা নাগাদ রায়নার খালেরপুল গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান সুমি খাতুন (৮) ও রুবি খাতুন (৬) নামে দুই বোন। এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ওই দুই বালিকার মা শিউলি বেগম রবিবার দুপুরে রায়না থানায় পরিকল্পনা করে খুনের অভিযোগ করেছেন। তিনি বধূ নির্যাতনেরও অভিযোগ জানিয়েছেন। তার ভিত্তিতে বধূ নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র করে খুনের মামলা দায়ের হয়েছে।’’
পুলিশ সূত্রের দাবি, শনিবার ওই ঘটনার সময়ে হাসিবুল বাড়িতে ছিলেন না। টোটো নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তিনি গ্রামে ফিরে আসতেই এলাকাবাসীর ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তাঁর উপরে। ঘিরে ধরে মারধর শুরু হয়ে যায়। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে রায়না থানায় নিয়ে যায়। রবিবার দুপুরে অভিযোগ পাওয়ার পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ দিন সকালে বর্ধমান শহরের অনতিদূরে খালেরপুল গ্রামে দেখা যায়, বর্ধমান-আরামবাগ রোডের ধারে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দুই কামরার বাড়িতে বাস হাসিবুলদের। রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান চালান বৃদ্ধা হুসনিহারা বিবি। মেয়ে দু’টির মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিজনেরা বাড়িতে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা অবশ্য এই ঘটনা ‘খুন’ বলে মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, ঘটনার সময়ে হাসিবুল বাড়িতে ছিলেন না। শিউলি মেয়েদের রেখে খণ্ডঘোষের দইচাঁদা গ্রামে বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুমা মেয়ে দু’টিকে আগলে রেখেছিলেন। মেয়েদের বাঁচাতে গিয়ে তিনিও জখম হয়েছেন।
অভিযুক্ত হুসনিহারা বিবির দাবি, ‘‘আমি চায়ের দোকানে ছিলাম। মেয়ে দু’টি দোকান লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় খেলছিল। চিৎকার শুনে এসে দেখি, বিদ্যুতের তারের সঙ্গে মেয়ে দু’টি জড়িয়ে রয়েছে। আমি ছাড়াতে গিয়ে জখম হই।’’ একই রকম দাবি করেন ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা ঝুমা শেখ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমিও ছুটে গিয়েছিলাম। সবাই চিৎকার করায় এগোয়নি। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা করি।’’ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সুমি স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। রুবি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিল।
যদিও মৃত দুই বালিকার মা শিউলিদেবী রায়না থানায় অভিযোগ করেছেন, স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কথা জানার পর থেকেই তাঁর উপরে নির্যাতন শুরু হয়। স্বামী-শাশুড়ির সঙ্গে এক মহিলা এসে তাঁকে মারধর ও অত্যাচার করত। তিনি বাপের বাড়ি খবর দেন। সেখান থেকে লোকজন এলে তিনি তাঁদের সঙ্গে বাপের বাড়ি চলে যান। তাঁর দাবি, ‘‘শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেয়েদের আটকে রেখে দিয়েছিল। আমি বাপের বাড়ি চলে আসার তিন দিনের মাথায় মেয়েদের খেলার জায়গায় বিদ্যুতের তারের সংযোগ করে রেখেছিল। পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে আমার মেয়েদের।’’
গোটা ঘটনা নিয়ে ধন্দ রয়েছে বলে দাবি পড়শিদের একাংশেরও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বৃদ্ধার দাবি, ‘‘নির্যাতনের শিকার হয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বাধ্য হত হাসিবুলের স্ত্রী। স্ত্রী-মেয়েদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল হাসিবুল, এমন অনেকের সন্দেহ।’’ স্থানীয় যুবক হাসেম শেখ, আবুল আলিমদের দাবি, ‘‘হাসিবুলের পক্ষে এমন কাণ্ড ঘটানো অসম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি। ঘটনার পরে তাই বাসিন্দাদের অনেকে তার উপরে চড়াও হয়েছিলেন।’’ পুলিশ সূত্রের দাবি, তাদের কাছে হাসিবুল দাবি করেছে, সজনে গাছের সঙ্গে বিদ্যুতের তারে বাল্ব ঝুলিয়েছিলেন শিউলিই। এখন তাঁকে মেয়েদের ‘খুনি’ সাজাতে চাওয়া হচ্ছে।
মৃতদের মেসোমশাই শেখ প্রতিন বলেন, ‘‘মেয়ে দু’টি চিপস্ কিনে আমার সামনেই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকল। তার পরেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ে থাকার দৃশ্য দেখলাম। দু’টো দৃশ্য এক সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছি না।’’ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা ‘শর্ট সার্কিট’ থেকে এমন ঘটেছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে। রায়না থানার পুলিশ জানায়, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পরে তদন্তের গতিপ্রকৃতি ঠিক হবে।