সুকুমার পাল (প্রিসাইডিং অফিসার)
আগে বেশ কয়েক বার ভোটের কাজ করেছি। তবে এ বার শুরুটা একদম ভাল হয়নি। পরিচিত প্রায় সকলের ভোটের কাজ করার চিঠি এলেও আমার আসেনি। ভাবলাম এ বার বুঝি রেহাই মিলল। শরীরটাও তেমন ভাল যাচ্ছিল না কয়েক দিন ধরে। ভাবলাম এই গরমে যদি ভোটের কাজের থেকে নিষ্কৃতি মেলে, তবে তো ভালই।
তবে শেষ মুহূর্তে চিঠিটা এসেই গেল। এ বারের ভোটে দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের নেপালিপাড়া সারদা প্রাথমিক স্কুলের বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়েছিলাম।
ভোটের জিনিসপত্র বিলি ও গ্রহণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) ছিল দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজে। ভোটের আগের দিন দুপুরে সেখানে পৌঁছে গেলাম। ভোটের যাবতীয় সামগ্রী বুঝে নিলাম। বিএসএনএলের সংযোগে সমস্যার জন্য মোবাইল নথিভুক্ত করতে বহু সময় কেটে গেল। সঙ্গে যোগ হল উপরি আরও এক সমস্যা। চারদিকে এত ধুলো। তার মধ্যে ভোটকর্মীদের পায়ে পায়েও বাতাস পুরো ধুলোময়। শুরু হয়ে গেল শ্বাসকষ্ট। কোনও রকমে নিজেকে সামলে বেরিয়ে এলাম গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে। এরপর চড়া রোদ মাথায় হেমশিলা মডেল স্কুলের সামনে নির্দিষ্ট বাস খুঁজে উঠে পড়লাম ভোটকেন্দ্রের উদ্দেশে। আমাদের দলে মোট পাঁচ জন ভোটকর্মী রয়েছেন।
আমরা বুথে পৌঁছবার আগেই কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে এসেছে ভোটকেন্দ্রে। আমাদের ঢুকতে দেখেই এক জওয়ান বললেন, ‘‘কোনও চিন্তা করবেন না। আমরা তো রয়েছি।’’ বুথে ঢুকে দেখি একটা মাত্র ঘর। সেখানেই রাতভর থাকতে হবে। সকালে ভোট। দু’টি বুথের জন্য একটিই শৌচাগার, তাও আবার তালাবন্ধ। যাই হোক, লোক ডেকে শৌচাগার খোলানোর খোলানোর ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখি শৌচাগার ভীষণ অপরিষ্কার অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কোনওরকমে পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থা করা হল। এ বার আমরা জরুরি সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে খানিক চোখ বোলানো শুরু করলাম। ততক্ষণে বেশ খিদেও পেয়েছে। কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা নেই বুথে। কোথাও কিছু না পেয়ে অগত্যা বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ধারের হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হল। বুথে পানীয় জলেরও স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। স্কুলে মিড ডে মিল রান্নার জন্য একটি জলের সংযোগ আছে বটে। তবে তাতে সবসময় জল পড়ে না। জল এলেও তা গরমে তেতে থাকে। হাত ধোওয়াটাই কঠিন ওই জলে।
রাত হতেই সকলে ঘুমনোর তোড়জোড় শুরু করলাম। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। ঘরময় ধুলো আর নোংরা। কোথাও ঝাঁটা নেই, যে একটু পরিষ্কার করে নেব। অগত্যা ধুলোতেই বিছানার চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুরু হল মশার উপদ্রব। মশার ধুপ জ্বালিয়েও তেমন লাভ হল না। মশার গুনগুনের সঙ্গে উপরি তীব্র গরম। কিছু সময় কাটিয়ে রাত ৩টে নাগাদ উঠে পড়লাম। সকাল ৬ টা’র আগেই সব সাজিয়ে বসে গেলাম ভোট নিতে।
নজরে পড়ল কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা। নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র ছাড়া ভোটকেন্দ্রের আশেপাশেও কাওকে ঘেঁষতেও দিলেন না জওয়ানরা। অন্যন্য ভোটকর্মীদের কাছে শুনলাম রাতভর ওঁরা আমাদের পাহার দিয়েছেন। বাইরের কেউ আমাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি। ভোটের কাজ করতে আসার আগে একটা সংশয় ছিল, যদি কোনও গোলমালে জড়িয়ে পড়ি...। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতায় নির্বিঘ্নেই ভোট মিটল। ভোট মেটার পর প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে নিয়মমাফিক ডিসিআরসি-র পথ ধরলাম। সেখানে ফের দীর্ঘ অপেক্ষা।
রাত ১০টায় ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির লোকজনও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
(লেখক সিলামপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক)