প্রাণ হাতে বাসের ছাদে। — ফাইল চিত্র।
ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে ছোটার মধ্যেই আচমকা উল্টে গিয়েছিল বাস। চাপা পড়েছিলেন বাসের ছাদে ও ভিতরে থাকা ৫০ জনেরও বেশি যাত্রী। এক জনের মৃত্যুও হয়। কাটোয়া-কেতুগ্রাম রুটে ন’নগর গ্রামের ওই ঘটনায় সোমবার মারা গিয়েছেন তরুণ দাস (৩৯) নামে আরও এক জন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান কেতুগ্রামের ভুলকুড়ি গ্রামের ওই যুবক। দুর্ঘটনার জেরে এ দিন জেলা জুড়ে বাসের বিধিভাঙা খুঁজতে নামে পুলিশ ও পরিবহণ দফতর। বাসের ছাদে ওঠার সিঁড়ি খোলা, জানালার পাশ দিয়ে ছাদে ওঠার মই খোলানো হয়। বাসের যন্ত্রাংশ, ছাদে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে কি না, সে সবও খতিয়ে দেখে পুলিশ। তবে কিছু দিন পরে দুর্ঘটনার রক্তের দাগ ফিকে হয়ে গেলে আবারও যথেচ্ছ যাত্রী তোলা, মেয়াদ উত্তীর্ণ যন্ত্রাংশ নিয়েই বাস চলবে কি না, সে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে অনেক যাত্রীর মনেই।
ন’নগরে দুর্ঘটনার সময়ের একটি ফুটেজ রবিবারই ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজ মাধ্যমে। অতিরিক্ত লাভের লোভে বাসের ছাদে যাত্রী তোলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বাস মালিক, পুলিশ, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ জানান তাঁরা। কাটোয়ার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলিতে এমন কিছু বাস চলে, যেগুলি প্রায় নড়বড়ে। বহু তাপ্পি দেওয়া টায়ার, ভাঙা কাঠামো নিয়েই অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয় বলে অভিযোগ। প্রশাসন কড়া না হওয়ায় যাত্রীদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় বলে দাবি অনেকের। কাটোয়া শহরের বাসিন্দা, এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী মানস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পেশাগত কারণে প্রতিদিনই বাসে চেপে নানা জায়গায় যাই। তিলধারণের জায়গা না থাকলেও চালক, খালাসিরা যাত্রী তুলতেই থাকেন। বাসের ছাদেও পণ্য, যাত্রী তোলা হয়। দুর্ঘটনার ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছে, যে কোনও দিন এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে পারি।’’
কাটোয়া বাস মালিক সমিতির সভাপতি নারায়ণচন্দ্র সেন বলেন, ‘‘সংগঠনের তরফে প্রত্যেক মালিককে বাসের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে বলা হয়েছে। প্রত্যেকেই তা করান। ওই ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক। তবে গ্রামের দিকে বা মাঝ রাস্তায় অনেক বেপরোয়া যাত্রীই জোর করে বাসের ছাদে ওঠেন। প্রতিবাদ করলে বচসা বেধে যায়। পুলিশ কড়া হোক, আমরাও চাই।’’
কাটোয়া মহকুমা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই বাসের ছাদে যাত্রী তোলা যাবে না। বাসের ফিটনেস শংসাপত্র ও চালকের লাইসেন্স সব সময়ে কাছে রাখতে হবে। ক্ষমতার উপরে যাত্রী তুললেই আইনি পদক্ষেপ করা হবে। লাগাতার নজরদারি চালিয়ে যাব।’’ কাটোয়ার ঘটনায় পরিবহণ দফতরের প্রযুক্তি বিভাগের আধিকারিকদের পর্যবেক্ষণ, স্টিয়ারিংয়ের কাছে থাকা ‘টাইরড’ ভেঙে যাওয়ায় চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারান। গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকা যন্ত্রটিও কাজ করেনি বলে তাঁদের অনুমান।
সোমবার সকাল থেকে কাটোয়া-কালনা এসটিকেকে রোডে নতুনগ্রামের কাছে, কাটোয়া-বর্ধমান রাস্তায় ও কাটোয়া-কেতুগ্রাম রোডের সংযোগস্থলে সিপাইদিঘির কাছে নজরদারি চালায় পুলিশ। বাসের স্বাস্থ্য দেখা হয়। ছাদে ওঠার সিঁড়ি ও রেলিং খোলানো হয়। টায়ার, চালকদের লাইসেন্সেও ছিল নজর। যাত্রী তোলা নিয়ে চালক ও খালাসিদের সতর্কও করা হয়। নজরদারির জেরে কালনা বাসস্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন রুটে চলা শ’খানেক বাসের কোনওটির ছাদেই যাত্রী দেখা যায়নি। ধাত্রীগ্রামে বাস চালকদের ছাদে যাত্রী না তোলা নিয়ে সতর্ক করে পুলিশ। কালনার এসডিপিও সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য অন্য আধিকারিকদের নিয়ে বেলা ১২টা নাগাদ নতুন বাসস্ট্যান্ডে যান। পুলিশ ও পরিবহণ দফতরের উপস্থিতিতে বহু বাসের ছাদ থেকে যাত্রীদের বসার বন্দোবস্ত খোলা হয়। বাস মালিক ও কর্মীদের নিয়ে বৈঠকও করা হয়। এসডিপিও বলেন, ‘‘যাত্রীরা বাসের চালককে চেনেন না। তাঁরা ভরসা রাখেন, চালক তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। চালক, কর্মী সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’’ নিয়মিত বাসের স্বাস্থ্যপরীক্ষার কথা বলেন সহকারী পরিবহণ আধিকারিক (এআরটিও) সৌমেন নন্দী, দীপঙ্কর দাসেরা।