দাসাই পরবে শামিল আদিবাসীরা। —নিজস্ব চিত্র।
গোটা রাজ্য যখন দুর্গাপুজোয় মাতোয়ারা, সেই সময় শোকের উৎসবে মাতলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রামের মালিয়ারা জঙ্গলমহল এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্গাপুজো হল শোকের সময়। আদিবাসীদের কাছে দুর্গার পরিচিতি ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে। তাই দেবীপক্ষে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা যখন দেবী দুর্গার আরাধনায় মগ্ন থাকেন, তখন নাচের মাধ্যমে দুর্গা অর্থাৎ ‘হুদুড় দুর্গা’কে খুঁজে বেড়ান আদিবাসীরা। ছদ্মবেশে ‘হুদুড় দুর্গা’কে খুঁজে বেরানোর আচার-অনুষ্ঠানই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ‘দাসাই পরব’ নামে পরিচিত। যে পরব পালনে আজও অবিচল রয়েছেন ওই এলাকার মানুষজনেরা।
তাঁদের কাছে এই পরবের মাহাত্মই আলাদা। সেই মাহাত্ম্য মেনেই শুক্রবার মহাষষ্ঠীর দিন থেকেই পরব পালনে মাতোয়ারা হলেন আউসগ্রামের মালিয়ারা জঙ্গলমহল এলাকার আদিবাসী মানুষজন। আদিবাসী সমাজের একাংশ মনে করেন, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী গোটা দেশে এখনও ‘অসুর জনজাতির’ মানুষের বসবাস রয়েছে। সেই আদিবাসী জনজাতির লোকজনই মহিষাসুর অর্থাৎ ‘হুদুড় দুর্গা’র উপাসক। তাই দুর্গা পুজোর সময়ে তাঁরা মহিষাসুরের পুজো করেন। রাঢ়বঙ্গ-সহ উত্তরবঙ্গের অসুর জনজাতির মানুষজন বিশ্বাস করেন, দুর্গা আসলে কোন নারী শক্তি নয়। তাঁদের মতে দুর্গা শক্তিশালী বলবান পুরুষ। সেই কারণে তাঁদের কাছে দুর্গা ‘হুদুড় দুর্গা’ নামেই পরিচিত।
আদিবাসী জনজাতির মানুষজন এ-ও বিশ্বাস করেন ‘অনার্যদের’ দেবতা হলেন অসুর। আর্যরা কখনওই অনার্যদের দেবতা ‘হুদুড় দুর্গার’ সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তাই দেবী রূপী দুর্গাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন দেবতারা। তাঁদের মতে, চিরাচরিত দুর্গা পুজোর কাঠামোয় অসুরকে যতই অত্যাচারী দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে মহিষাসুর ছিলেন ঠিক তার উল্টোটাই। যুদ্ধে ‘অসুর’ কোনও মহিলা ও শিশুদের আঘাত করতেন না। সেই দুর্বলতা জেনে দেবতারা নাকি বিজয়লাভ করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দুর্গাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। নিজের নীতিতে অবিচল মহিষাসুর তাই দুর্গার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হন। এই বিশ্বাসে ভর করেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন দুর্গাপুজোর সময়ে ছদ্মবেশে নাচের মাধ্যমে তাঁদের অনার্য ভগবানকে খুঁজে থাকেন। মূলত ভাদ্র মাস শেষ হতেই আদিবাসী মহল্লায় শুরু হয়ে যায় দাসাই পরব পালনের প্রস্তুতি। পুজোর ষষ্ঠীর দিন থেকেই পুরুষেরা নারী সেজে ধামসা ও মাদল নিয়ে ‘দাসাই নাচে’ মাতোয়ারা হন। দশমী পর্যন্ত চলে এই দাসাই পরব ।
আদিবাসী ‘অসুর জনজাতির’ লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী, অসুরেরা এই দেশের প্রাচীন জনজাতি। তাদের নেতার নাম ছিল ‘হুদুড় দুর্গা’ অর্থাৎ ‘মহিষাসুর’। সাঁওতালি ভাষায় দুর্গা পুংলিঙ্গ। সাঁওতালি ভাষায় ‘হুদুড়’ কথার অর্থ প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস। আর্য সেনাপতি ‘ইন্দ্র’ ছলনা এবং কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এক দেবীকে ‘হুদুড় দুর্গা’র কাছে পাঠান। ওই দেবী হুদুড় দুর্গাকে বিয়ে করার পর নবমীর দিন হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করেন। সেই কারণে ওই দেবী দুর্গাদেবী নামে পরিচিতি পান। অসুর জনজাতির মানুষজন এই লোককথাকে বিশ্বাস করেই শতকের পর শতক দুর্গোৎসবের চার দিন শোকের পরব দাসাই পালন করে আসছেন। আদিবাসী পুরুষেরা নারীর বেশে, মাথায় ময়ূরের পুচ্ছ লাগিয়ে ‘ভুয়াং’ নাচের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে দুঃখের গান গেয়ে এই সময়ে খুঁজে থাকেন তাঁদের মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গাকে।
রাজ্যের শাসক দলের আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর নেতা দেবু টুডু বলেন, “আদিবাসী সংস্কৃতির অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আদিবাসী সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরব দাসাই পরব। সেই পরবকে সামনে রেখেই নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বহু আদিবাসী দুর্গা পুজোর ক’টা দিন দাসাই পরবের অনুষ্ঠানে শামিল হন।”