ইঙ্গিত মিলেছিল পুরভোটেই। অন্যত্র ভরাডুবির মাঝেও রানিগঞ্জে ভাল ফল করেছিল বামেরা। মাস আটেক আগের সেই ভোট থেকেই রানিগঞ্জ বিধানসভা আসনও পুনর্দখলের রাস্তা দেখতে পাচ্ছিল তারা।
১৯৬২ থেকে হাতে থাকা রানিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১১ সালে হার হয় বামেদের। সে বার এলাকা পুনর্বিন্যাসের পরে রানিগঞ্জ পুর এলাকা ও অন্ডালের ৮টি পঞ্চায়েত ছিল এই কেন্দ্রের অধীনে। তার আগে রানিগঞ্জের ছ’টি পঞ্চায়েত ও পুর এলাকা ছিল এর অন্তর্গত। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৬৭ সালের আগেও এই কেন্দ্র ছিল রানিগঞ্জ পুর ও অন্ডাল ব্লক নিয়ে গড়া। ’৬৭ সালে পাণ্ডবেশ্বর ও অন্ডাল ব্লক নিয়ে উখড়া এবং রানিগঞ্জের পুর ও গ্রামীণ এলাকা যোগ করে রানিগঞ্জ কেন্দ্র তৈরি হয়। গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সোহরাব আলির কাছে প্রায় সতেরোশো ভোটে সিপিএমের রুন দত্ত হেরে যাওয়ায় ৪৯ বছর পরে এখানে হার হয় বামেদের। এ বার সেই রুনুবাবুই তৃণমূল প্রার্থী তথা সোহরাবের স্ত্রী নার্গিস বানোকে হারিয়ে দিয়েছেন ১২ হাজারের বেশি ভোটে।
২০১১-য় এই কেন্দ্রে হারলেও সিপিএম পুর এলাকায় তৃণমূলের থেকে ২০২০ ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু শ্রীরামপুর, অন্ডাল, রামপ্রসাদপুর ও উখড়া— এই চার পঞ্চায়েতে মোট ৮২০০ ভোটের ‘লিড’ জিতিয়ে দেয় তৃণমূলকে। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে ৬টি পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করে। কাজোড়া বামেদের দখলে থাকলেও বছরখানেকের মধ্যে এক পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় সেটি হাতছাড়া হয়। বামেদের ঝুলিতে থেকে যায় শুধু খান্দরা পঞ্চায়েত। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ বারও অন্ডালের ভোট তাঁদের জেতাবে বলে আশায় ছিলেন দলীয় নেতৃত্ব।
কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। বিধানসভা ভোটে গত বার যে চারটি পঞ্চায়েত তাদের জয়ে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, এ বারও সেখানে এগিয়ে তৃণমূল। কিন্তু ব্যবধান ৮২০০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭৩৯। সামগ্রিক ভাবে, অন্ডালে সিপিএম প্রায় ২৮০০ ভোটে এগিয়ে যায় তৃণমূলের থেকে। ও দিকে, রানিগঞ্জ পুর এলাকায় তৃণমূলের থেকে সিপিএম ৯৫২৬ ভোট বেশি পেয়েছে।
৪৯ বছর বামেদের হাতে থাকা কেন্দ্র দখল করার পাঁচ বছরের মধ্যে আবার তা খোয়ানোর কারণ কী? তৃণমূলের নানা সূত্রের মতে, পুর এলাকায় পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়াই এর বড় কারণ। অক্টোবরে আসানসোলের পুরভোটে ১০৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে বামেরা জিতেছিল ১৭টিতে। কিন্তু তার মধ্যে রানিগঞ্জের ১১টি আসনের মধ্যেই জেতে ৫টিতে। তৃণমূল তখন যে ৬টি ওয়ার্ডে জিতেছিল, এ বার তার মধ্যে একটি ছাড়া (৮৮ নম্বর) সবেতেই সিপিএমের থেকে পিছিয়ে পড়েছে তারা। তবে পুরভোটে সিপিএমের কাছে হেরে যাওয়া দুই ওয়ার্ডে (৩৫ ও ১৯ নম্বর) তৃণমূল এগিয়ে থেকেছে।
এই পরিস্থিতির নানা রকম ব্যাখ্যা মিলছে তৃণমূল নেতাদের থেকে। রানিগঞ্জ শহর তৃণমূল সভাপতি অলোক বসু দাবি করেন, “পুরভোটে জেতার পরে পাঁচ কাউন্সিলরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তার প্রভাব ভোট বাক্সে পড়েছে। দল হারের কারণ নিয়ে সমীক্ষা করছে।’’ তৃণমূলের একটি সূত্রের আবার দাবি, অলোকবাবুকে দলের শহর সভাপতি করা নিয়ে আগের বিধায়ক সোহরাব আলির আপত্তি ছিল। দলের উচ্চ নেতৃত্বের কাছে সে কথা জানিয়েও ছিলেন। তার পরেও জেলা কমিটি অলোকবাবুকে পদ থেকে না সরানোয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তৈরি হয়। রেলের লোহা চুরির একটি মামলায় সোহরাব দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এ বার তাঁর বদলে স্ত্রী নার্গিসকে প্রার্থী করে দল। তাঁকে জেতাতে সোহরাব শহর সভাপতির সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর অনুগামী কিছু নেতা-কর্মী তা মানতে পারেননি। তাঁরা ভোটের সময়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান বলে তৃণমূলের ওই সূত্রের দাবি। জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘অর্ন্তকলহ মেটাতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় রানিগঞ্জে এই পরিণতি হল।’’
প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় অন্ডালেও দলের একটি অংশ সে ভাবে মাঠে নামেনি বলে ব্লক তৃণমূলের একাংশের দাবি। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, দলের এক জেলা পরিষদ সদস্য প্রায় প্রকাশ্যেই অনুগামীদের অন্য দলকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রামপ্রসাদপুর পঞ্চায়েত এলাকায় গত বার যেখানে হাজার দেড়েক ভোটে এগিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী, এ বার সেখানে তা কমে দাঁড়ায় ১৪৯। দুর্নীতির অভিযোগ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতেও ভোট কমেছে বলে মনে করছেন জেলা তৃণমূলের নেতারা। দলের অন্ডাল ব্লক সভাপতি কাঞ্চন মিত্র শুধু বলেন, “ব্লক সভাপতি হিসেবে হারের দায় আমি নিচ্ছি।” সোহরাব আলি অবশ্য এ সব ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, ‘‘দল তদন্ত করে যা বলার বলবে।’’
সিপিএমের রুনুবাবুর বক্তব্য, “আমরা গত বার হেরে গেলেও জনসংযোগ বাড়িয়ে গিয়েছি। পুরভোটে এখানে ৫টি ওয়ার্ডে জেতার পরে বুঝতে পারি, আমাদের প্রতি মানুষের সভানুভূতি কমেনি। শ্রমিক সংগঠন জোর করে শাসক দল দখল করার চেষ্টা করলেও নিজেদের বিকল্প সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি। মানুষ অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় এ সবের ফসল আমরা পেয়েছি।’’