কান্নায় ভেঙে পড়েছেন শিশুর পরিজনেরা। ময়নাগুড়ি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।
খেলা করার জন্য প্রায়ই দেড় বছরের শিশুটিকে নিয়ে যেতেন পড়শি যুবক। কিছুক্ষণ পরে বাড়ি পৌঁছেও দিয়ে যেতেন। বুধবারও কোলে করে জয় কিস্কুকে নিয়ে গিয়েছিলেন বছর বাইশের গোবিন্দ কিস্কু। বেশ কিছুক্ষণ পরে জয় না ফেরায় খোঁজ শুরু করেন বাড়ির লোকেরা। গোবিন্দদের খামারবাড়ির একটি টিনের ঘর থেকে রক্তাক্ত দেহ মেলে তার। পাশে গলা ও হাত কাটা অবস্থায় পড়েছিলেন গোবিন্দও। পরে কালনা হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। তবে কালনা ২ ব্লকের বড়ধামাস পঞ্চায়েতের ময়নাগুড়ি এলাকার দুই বাসিন্দার মৃত্যুর কারণ একেবারেই স্পষ্ট নয় পরিবারের কাছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ধ্রুব দাস বলেন, ‘‘মৃত শিশুর বাবা একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তার ভিত্তিতে মামলা দায়ের হয়েছে। দু’টি দেহ ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে বর্ধমানে।’’
ময়নাগুড়ি আদিবাসীপাড়ায় ১৫ ঘর পরিবারের বাস। বেশির ভাগেরই জীবিকা খেতমজুরি। সেখানেই একটি ছোট্ট বাড়িতে বাস করেন অঞ্জলি কিস্কু এবং সঞ্জয় কিস্কু। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ দিন সকালে সঞ্জয় মাঠের কাজে বেরিয়ে যান। তার আগেই সাড়ে ৬টা নাগাদ তাঁদের ছোট ছেলে জয়কে কোলে তুলে বাড়ি থেকে আদর করতে করতে নিয়ে যান প্রতিবেশী গোবিন্দ। কিছুক্ষণ পরে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন বলেও জানান। তবে জয়ের ফিরতে দেরি হওয়ায় খুঁজতে যান তার জেঠা বিজয় কিস্কু। তাঁর দাবি, গোবিন্দর বাড়ি থেকে প্রায় তিনশো মিটার দূরে একটি পুকুর পাড়ে টিনের বাড়িতে পড়েছিল জয়ের রক্তমাখা দেহ। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ি ফিরে এসে ঘটনাটি জানান। নাতির কাছে ছুটে যান ঠাকুমা মুগলি কিস্কু। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘নাতিটা সবে মাত্র ‘দাদা, দিদি’ বলতে শিখেছিল। ওইটুকু শিশুর যে এত বড় ক্ষতি হবে ভাবতে পারছি না!’’ তাঁর দাবি, ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা নাতির চোখে-মুখে রক্ত লেগেছিল। পাশে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদছিলেন গোবিন্দ। কোনও কথা বলেননি। ওই প্রৌঢ়ার দাবি, ‘‘প্রথমে মনে হয়েছিল, নাতি অচৈতন্য। পরে দেখা যায়, গলাকাটা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।’’
প্রতিবেশীদের দাবি, কিছুক্ষণ পরেই ওই ঘর থেকে গলা এবং বাঁ হাতের কব্জির কাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় গোবিন্দকে। তাঁকে কালনা মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সকাল ৯টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত শিশুর জেঠিমা বুদিনি মুর্মু বলেন, ‘‘উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গোবিন্দ মেমারি কলেজে ভর্তি হয়েছিল। যদিও বছর দু’য়েক আগে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। মাঝেমধ্যেই জয়কে বাড়ি থেকে নিয়ে যেত। এ বার কী করে যে এমন ঘটনা ঘটে গেল, আমরা কিছুতেই মেলাতে পারছি না।’’ প্রতিবেশী মদন হাঁসদা, স্বপন সরেন, মিলন ক্ষেত্রপালেরাও জানান, যে ঘরে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে মাঝেমধ্যেই ছাত্রদের পড়াতেন গোবিন্দ। এলাকায় শান্তশিষ্ট ছেলে হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। পুরো ঘটনাটাই ধোঁয়াশা, বলছেন তাঁরা।
গোবিন্দের বাড়িতেও ছিল কান্নার রোল। তাঁর মা মিনতি কিস্কুর দাবি, সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলে দাঁত মাজতে যায়। আর ফেরেনি। তাঁর সন্দেহ, ছেলে ঘটনাটি ঘটায়নি। অন্য কেউ রয়েছে এর পিছনে। এ দিন ঘটনাস্থলে যায় বুলবুলিতলা ফাঁড়ির পুলিশ। দফায় দফায় পুলিশের তরফে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দুই পরিবারের সদস্যদের। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনার কারণ নিয়ে ধন্দে পুলিশ। পুলিশের দাবি, গোবিন্দর মোবাইলের স্ক্রিনে জয়ের ছবি রয়েছে। ফলে, ধরে নেওয়া যায় শিশুটিকে ভালবাসত সে। তার সঙ্গে কেন এমন করা হল, তৃতীয় কেউ রয়েছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোবিন্দর বাঁ হাতে ক্ষত রয়েছে। গলার ক্ষতও বেশ গভীর। নিজেকে এ ভাবে আঘাত করা, খুব একটা সহজ নয় বলেও তদন্তকারীদের দাবি।