কালনায় রেশন পাওয়ার জন্য অপেক্ষার লাইনে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধা। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল
ডিজিটাল কার্ড থাকলেও রেশন দিচ্ছেন না ডিলার। কারচুপি হচ্ছে ওজনে। দেওয়া হচ্ছে না আটা। শুক্র এবং শনি—দু’দিন ধরে রেশন বিলি নিয়ে পূর্ব বর্ধমানের নানা প্রান্তে উঠল এমনই নানা অভিযোগ। অনেক জায়গায় আবার করোনা-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি না মানা, দোকানে উপভোক্তাদের তালিকা না ঝোলানোর মতো অভিযোগও উঠেছে।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বক্তব্য, ‘‘বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু অভিযোগ আসছে। বেশ কিছু ইচ্ছাকৃত ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। তবে প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখে রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’ জেলা খাদ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, গত দু’দিনে বর্ধমান শহরের এক, কালনার তিন ও মন্তেশ্বরের এক জন ডিলারকে ‘শো-কজ়’ করা হয়েছে।
সুশৃঙ্খল ভাবে রেশন দেওয়া নিয়ে বৃহস্পতিবার পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন খাদ্যমন্ত্রী। সে দিন বিকেলে জেলার খাদ্য দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিটি ব্লকে টাস্ক ফোর্স তৈরি করেন জেলাশাসক বিজয় ভারতী। শুক্রবার থেকে প্রতিটি ব্লকে খাদ্য নিয়ামক, ব্লক আধিকারিক, মহকুমাশাসকেরা রেশন দোকানে গিয়ে তদারক করেন। প্রতিটি রেশন দোকানের সামনে সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়েন করা হয়। তবে তার পরেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
বর্ধমান শহরের উপভোক্তাদের একাংশের দাবি, নীলপুর, কোটালহাট, পারবীরহাটার রেশন ডিলারেরা আটার প্যাকেট দেননি। নীলপুরের রিমা দাস, কোটালহাটের পলা ভট্টাচার্যদের অভিযোগ, ‘‘রেশন ডিলার আমাদের জানিয়েছেন, আটার প্যাকেটের সরবরাহ নেই। তাই আমাদের দিতে পারেননি। কয়েকদিন পরে খোঁজ নিতে বলেছেন।’’ কালনা রোডের একটি দোকানে ১৫ দিনের আটা দিলেও, এক মাসের দেওয়া হচ্ছে বলে লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। উপভোক্তাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন ডিলার। সিভিক ভলান্টিয়ারেরা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। মেহেদিবাগানে এক রেশন ডিলার প্রাপ্য সাত কেজির বদলে উপভোক্তাদের সাড়ে চার বা পাঁচ কেজি চাল দিচ্ছেন, এই অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। উপভোক্তা কবিতা প্রসাদ, বারুই প্রসাদদের অভিযোগ, ‘‘শুক্রবার থেকেই কম পরিমাণে চাল দেওয়া হচ্ছিল।’’ দোকানের ম্যানেজার মানিক চক্রবর্তী দাবি করেন, ‘‘যান্ত্রিক গোলমালে সম্ভবত ওজন কম হয়েছে। ভুল মেনে নিচ্ছি।’’
কালনায় রেশন দোকান পরিদর্শনে বেরোন মহকুমাশাসক সুমনসৌরভ মোহান্তি, মহকুমা খাদ্য নিয়ামক অভিজিৎ বেজ। প্রশাসন সূত্রের খবর, তাঁদের চোখে কিছু অনিয়ম ধরা পড়ে। ‘ই-পিওস’ যন্ত্র থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে না, এমন কয়েকটি দোকান দেখা যায়। কালনা শহর ঘেঁষা এক রেশন ডিলার ডিজিটাল কার্ডের পরিবর্তে নিজের দেওয়া একটি ‘কার্ড’ অনুযায়ী, উপভোক্তাদের খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া, অনেক ডিলার ‘বিল’ দিচ্ছেন না বলেও জানতে পারেন কর্তারা।
কেতুগ্রামের আনখোনায় রেশনে জিনিস কম দেওয়ার অভিযোগে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়। কাটোয়া ১ ব্লকে কলসা গ্রামের উপভোক্তাদের একাংশের অভিযোগ, চার কিলোমিটার দূর থেকে রেশন আনতে যেতে পারছেন না তাঁরা। যদিও কাটোয়া মহকুমা খাদ্য নিয়ামক দেবলীনা ঘোষের বক্তব্য, ‘‘আমি দু’টি ব্লকে ঘুরেছি। কোথাও কোনও অভিযোগ পাইনি। কেউ যদি লকডাউনের জন্য রেশন আনতে যেতে না পারেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে।’’ আউশগ্রামের ভেদিয়ায় এক ডিলার কম খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরেন প্রশাসনের আধিকারিকরা। মুচলেকা লিখিয়ে ওই ডিলারকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ দিন সকাল থেকে বর্ধমানে জেলা খাদ্য ভবনের সামনে লম্বা লাইন পড়ে। অধিকাংশদের অভিযোগ, এখনও ‘ফুড কুপন’ পাননি। কয়েকজন আবার ডিজিটাল কার্ড দেখিয়ে দাবি করেন, এই কার্ডেও রেশন মিলছে না। বাদশাহি রোড মাঠপাড়ার দীনেশ জয়সওয়াল, লক্ষ্মীপুর মাঠপাড়ার শম্ভুপ্রসাদ গুপ্তদের অভিযোগ, ‘‘ডিজিটাল রেশন কার্ড থাকার পরেও, ডিলার জিনিস দিতে চাইছেন না। ডিলারের খাতায় নাকি আমাদের নাম নেই!’’ বাবুরবাগের সীমা মালিক, লোকো এলাকার অমিত দাসেরা আবার অভিযোগ করেন, ‘‘এপ্রিলে রেশন তুলেছি। এই মাসে রেশন আনতে গেলে বলা হচ্ছে, আমাদের নাকি নাম নেই! এমনটা কী করে সম্ভব?’’
জেলাশাসক (পূর্ব বর্ধমান) বিজয় ভারতী বলেন, ‘‘বৈধ কার্ড থাকলে রেশন ডিলার জিনিস দিতে বাধ্য। না হলে ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ জেলা খাদ্য নিয়ামক আবির বালি বলেন, ‘‘প্রত্যেকের অভিযোগ শোনার মতো পরিস্থিতি নেই। সে জন্য দফতরের গেটে অভিযোগ-বাক্স রাখা হয়েছে। সেখানে থাকা অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুরসভার এগজ়িকিউটিভ অফিসারদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে।’’ এ দিন রেশন বণ্টনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রায়নার ১১টি দোকান ঘুরে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল এমআর ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর জেলা সম্পাদক পরেশনাথ হাজরার বক্তব্য, ‘‘শহরাঞ্চলে সমস্যা রয়েছে। তদারকি বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।’’