খোঁজ নেই বহু মানুষের। — ফাইল চিত্র।
লকডাউনের সময়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন কাটোয়ার করুই গ্রামের সমীর রায়। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে ফের চেন্নাই রওনা দিয়েছিলেন তিনি। ভাতারের ভাটাকুল গ্রামের খোকন শেখ এ বারই বাড়তি রোজগারের আশায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে চেন্নাই যাচ্ছিলেন। শুধু সমীর বা খোকন নন, তামিলনাড়ু থেকে কেরলে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছিলেন আরও অনেক জন। শুক্রবার বিকেলে কেউ শালিমার, কেউ সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপেছিলেন তাঁরা। সন্ধ্যায় ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে ট্রেনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ার পরে সমীরের মতো পূর্ব বর্ধমানের অন্তত ১০৯ জন জখম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর জখম ১১ জন। আর খোকনের মতো অন্তত ছ’জনের খোঁজ নেই শনিবার রাত পর্যন্ত।
জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা শনিবার বিকেলে বলেন, ‘‘জেলার সাত জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। মৃতদের দেহ এবং আহতদের জেলায় আনতে পশ্চিম মেদিনীপুরে আমাদের চার আধিকারিক রয়েছেন।’’ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলাশাসকের বাংলো থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিক ও কর্মীরা রাতভর কাজ করছেন। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কাটোয়া, বর্ধমান ও কালনা স্টেশনে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া, পর্যাপ্ত অ্যাম্বুল্যান্স ও গাড়ি রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে মৃতদের পরিজনদের সঙ্গে ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরা কথা বলেছেন।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি আহতের সংখ্যা মন্তেশ্বর (২০) ও ভাতারে (১৫)। এ ছাড়া, বর্ধমান ২, কেতুগ্রাম ২, মঙ্গলকোট ব্লকের চার জন করে জখম রয়েছেন। কাটোয়া ২ ব্লকেও সাত জন আহত। কাটোয়া ২ ব্লকের গাজিপুরের দু’জন নিখোঁজ রয়েছেন। পূর্বস্থলী ২ ব্লকেরও বেশ কয়েক জন জখম হয়েছেন। প্রশাসনের দাবি, নিখোঁজের তালিকায় আউশগ্রাম, মন্তেশ্বর ও ভাতারের লোকজনের নাম রয়েছে। মহকুমাশাসক (কালনা) সুরেশকুমার জগৎ বলেন, ‘‘আমাদের মহকুমায় অন্তত ১৫ জন জখম হয়েছেন। তিন জন নিখোঁজ বলে জেনেছি।’’
ট্রেন দুর্ঘটনায় জখম কাটোয়ার করুই গ্রামের সমীর রায়ের পরিজনেরা জানান, লকডাউনে বাড়ি ফেরার পরে আর কেরলে যাননি তিনি। ফের সেখানে কাজের চাহিদা বাড়তে থাকার খবর পেয়ে শুক্রবার রওনা দেন। আট জন এক সঙ্গে যাচ্ছিলেন। পাঁচ জন ফিরছেন।’’ ভাতারের নিখোঁজ খোকনের স্ত্রী বুল্টি বলেন, ‘‘আমরা গরিব। চাষের কাজে নানা জায়গায় যেত স্বামী। মুর্শিদাবাদের দু’জনের সঙ্গে এ বার চেন্নাই যাচ্ছিল।’’ খোকনের মা কামু বিবি বলেন, ‘‘বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি। নাতিরা কেঁদে চলেছে।’’
ভাতারের সবুজ শেখ, হাবিবুল্লা শেখরা শনিবার সকালে নিজেরাই বাড়ি ফিরে ভাতার গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। তাঁদের বর্ণনায়, ‘‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। চার দিকে আর্তনাদ। দেহ টপকে পেরিয়ে রাস্তায় এসেছি।’’ চাষের কাজ করতে অন্ধ্রপ্রদেশ যাচ্ছিলেন মন্তেশ্বরের দেবু সাঁতরা, হৃদয় বাগেরা। হৃদয়ের আত্মীয় লাল বাগ বলেন, ‘‘শুক্রবার সন্ধ্যায় দুর্ঘটনার পরে হৃদয়ের সঙ্গে এক বার কথা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। চিন্তায় রয়েছি।’’ পূর্বস্থলী ২ ব্লকের মহাদেবপুরের প্রণব কোলে, রণিক কোলে ও অমল কোলে এক সঙ্গে যাচ্ছিলেন। গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলী পাল এ দিন বিকেলে বলেন, ‘‘দু’জনের খোঁজ পাওয়া গেলেও, এক জন নিখোঁজ।’’ ওই ব্লকের জ্বালাহাটি, বাগানপাড়ার অনেকে আহত হয়েছেন বলে এলাকাবাসীর দাবি। এক আহতের আত্মীয় আশা বিবি বলেন, ‘‘বাড়ি না ফেরা অবধি চিন্তায় আছি।’’
মেমারির বোহারের তিন জন জখম হয়েছেন বলে খবর। বালেশ্বরের একটি হাসপাতাল থেকে সাহেব আলি ফোনে বলেন, ‘‘আমরা বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ গাড়িটা দুলতেই সাইড বার্থ থেকে তিন জন উল্টে পড়লাম।’’ সঙ্গী ফিরোজ শেখের কথায়, ‘‘আপাতত চেন্নাই বা কেরলে কাজে যাওয়া হবে না। বাড়িতেই থাকতে হবে।’’