কয়লা ব্যবসার সঙ্গে পরিচিতদের একাংশ জানাচ্ছেন, চুরি করা কয়লা বিক্রি করতে ডিও-র বৈধ নথি দরকার হয়। প্রতীকী ছবি।
কয়লার ‘ডিও’ অর্থাৎ ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে ব্যবসা করাটা বৈধ। কিন্তু এই বরাতকে কেন্দ্র করেই গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার পশ্চিম বর্ধমানের নানা প্রান্ত তেতে উঠেছে। ঘটেছে রক্তপাত, প্রাণহানি। সম্প্রতি দুর্গাপুরের গুলি-কাণ্ডের নেপথ্যেও ডিও সংক্রান্ত গোলমাল থাকতে পারে বলে প্রাথমিক ভাবে অনুমান করছেন তদন্তকারীদের একাংশ।
ইসিএলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা জামান, ইসিএল অথবা কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা সংস্থা সরাসরি ‘স্পট ই-অকশন’-এর মাধ্যমে কয়লা কেনার (দৈনিক এক থেকে দশ হাজার টন) অনুমতি দেয় কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে। এর পরে, কয়লা কিনে সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃপক্ষ অথবা ব্যক্তি ঠিক করেন, সে কয়লা কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, কোথায় তা বিক্রি করা হবে। কয়লা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠাতে বরাত পাওয়া ব্যক্তি অথবা সংস্থা কর্তৃপক্ষ কমিশনের বিনিময়ে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে থাকেন। কারবারের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এই কয়লা পাঠানো অর্থাৎ পরিবহণ এবং তাতে মজুর নিয়োগকে কেন্দ্র করেই বার বার বিবাদ দেখা যাচ্ছে।
কী ধরনের ও কেন বিবাদ? ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ জানাচ্ছে, মজুর নিয়োগের দায়িত্বে থাকা গোষ্ঠী ঘুরপথে ডিও-র বরাত যে বা যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদেরকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে। জড়িয়ে পড়ে কয়লা কারবারেও। এই সূত্রেই তৈরি হয় গোলমাল। অভিযোগ, ২০২০-র ১১ নভেম্বর অন্ডালের খাসকাজোড়ায় দু’টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে এক জনের মৃত্যু হয়। ২০২১-এর ১৪ সেপ্টেম্বর অন্ডালের বিশ্বেশ্বরী কোলিয়ারি, ২০২২-এর ৪ মার্চ সিঁদুলি কোলিয়ারির ডিও-র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বোমাবাজির ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। ২০২২-এর জুলাইয়ে জামুড়িয়ায় ইসিএলের কুনুস্তোড়িয়া এরিয়ার এক ডিও প্রাপকের প্রতিনিধি সরাসরি পুলিশের কাছে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
পাশাপাশি, প্রশ্ন উঠছে ডিও-র কারবার ‘নিয়ন্ত্রণটা’ জরুরি হয়ে উঠেছে কেন। কয়লা ব্যবসার সঙ্গে পরিচিতদের একাংশ জানাচ্ছেন, চুরি করা কয়লা বিক্রি করতে ডিও-র বৈধ নথি দরকার হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিও প্রাপক জানাচ্ছেন, তাঁদের খনি থেকে কয়লা তোলার জন্য কোনও-কোনও গোষ্ঠীকে বেশ কয়েক মাস টন প্রতি কয়লার জন্য তিনশো থেকে ছ’শো টাকা দিতে হচ্ছে। একে স্থানীয় ভাবে তাঁরা ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ও বলছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে সরব হয়েছেন বিরোধীরাও। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য পার্থ মুখোপাধ্যায় এবং বিজেপি-র আসানসোল সাংগঠনিক জেলা সভাপতি দিলীপ দে’র কার্যত এক সুরে অভিযোগ, “রাজ্য জুড়েই অবৈধ কারবারের রমরমা। কয়লা চুরির লাগাম যে টানা যাচ্ছে না, তা বার বার প্রমাণিত হচ্ছে।” অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক ভি শিবদাসন বলেন, “পুলিশের তৎপরতায় অবৈধ কয়লার কারবার পুরোপুরি বন্ধ। ইসিএলের নিরাপত্তা বিভাগ সজাগ থাকলে ভবিষ্যতে এ কাজ শুরুই হবে না।”
এ দিকে, আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুধীরকুমার নীলাকান্তাম জানান, অভিযোগ পেলেই পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। এ ছাড়া, নিয়মিত জেলা জুড়ে নাকা তল্লাশির ফলে প্রচুর পরিমাণে চুরি করা কয়লা উদ্ধার করা হয়েছে। ইসিএলের জেনারেল ম্যানেজার (নিরাপত্তা) শৈলেন্দ্রকুমার সিংহের অবশ্য দাবি, “ডিও সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও গন্ডগোলের খবর জানা নেই। পুলিশ ও সিআইএসএফের সহায়তায় নিয়মিত অবৈধ কয়লা পাচার বন্ধে অভিযান চালানো হয়।”