পড়ে রয়েছে বৃদ্ধার নিথর দেহ। বুধবার অগ্রদ্বীপে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
গাংনাপুরের কনভেন্টে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণ নিয়ে যখন বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে, তার মধ্যেই ফের একই ধরনের ঘটনা ঘটে গেল বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে।
এ বার অবশ্য শুধু নির্যাতনেই শেষ নয়, খুন করা হয়েছে বৃদ্ধাকে। যাঁর বয়স বিরাশি বছর, রানাঘাটের গাংনাপুরের ওই সন্ন্যাসিনীর চেয়েও প্রায় আট বছর বেশি। দু’টি ঘটনার কোনওটিতেই বুধবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে রানাঘাটের মতো অগ্রদ্বীপেও বেশ কয়েক জনকে পুলিশ আটক করেছে।
কাটোয়ার অগ্রদ্বীপে গত সোমবার থেকেই গোপীনাথের মেলা বসেছিল। মঙ্গলবার অন্ন মহোৎসব হয়, বুধবার ছিল মেলার শেষ দিন। বৃদ্ধার বাড়িতে প্রতি বারই আখড়া বসে। এ বারও বসেছিল। সকালে বাড়ির শৌচাগারের কাছেই বৃদ্ধার নগ্ন রক্তাক্ত দেহ চিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। নানা জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। দেহের পাশে নস্যি রঙের ফুল প্যান্ট, এক জোড়া জুতো, এক তাড়া বিড়ি ও একটি লাইটার পেয়েছে পুলিশ। পরিবারের সন্দেহ, বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করে ভারী কিছু দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয়েছে।
নদিয়ার চাপড়া থেকে যাঁরা এসে আখড়া বসিয়েছিলেন, তাঁদের কিছু সকালেই উধাও হয়ে যান। বাকিদের পুলিশ আটক করেছে। কিন্তু কেন এই খুন, তা নিয়ে পুলিশ ধন্দে। শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন বা পিডোফিলিয়া আদৌ অচেনা নয়। কিন্তু হঠাৎ বৃদ্ধারা লক্ষ্য হচ্ছেন কেন?
মনোবিদ হিরন্ময় সাহার মতে, “পূর্ব ইউরোপ কিংবা পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ‘পিডোফিলিয়া’র যথেষ্ট প্রকোপ। তবে বয়স্কদের উপরে এমন নির্যাতন ব্যতিক্রমী ঘটনা। মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাসে এর বিশেষ নজির নেই।” যদিও বয়স্কদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ বা জেরান্তোফিলিয়া আদৌ বিরল নয়। কিন্তু এই দুই ঘটনা সেই গোত্রে পড়ে না। হিরন্ময়বাবুর মতে, “এই নির্যাতন একান্ত ভাবেই প্রতিহিংসার মনোবৃত্তি থেকে ঘটানো হয়েছে বলেই মনে হয়। মনে রাখতে হবে, প্রতিহিংসার সময়ে মানুষের বিকৃতির প্রকাশ সবচেয়ে বেশি ঘটে। দু’টি ক্ষেত্রেই যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেয়ে সম্ভবত প্রতিহিংসা-স্পৃহাই বেশি কাজ করেছে।”
বেশ কয়েক বছর ধরেই নদিয়ার চাপড়া থেকে অগ্রদ্বীপে আসছিল আখড়ার দলটি। তার মালিকের বয়স আশিরও বেশি। মৃতার ছেলে কাটোয়া থানায় সেই বৃদ্ধ ও তাঁর পরিচিতদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে তদন্তকারী চিকিৎসক বলেন, “বৃদ্ধার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার চিহ্ন রয়েছে। ধস্তাধস্তির চিহ্নও মিলেছে। ধর্ষণ হয়েছে কি না নিশ্চিত করার জন্য দেহ ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে।”
অগ্রদ্বীপ ও রানাঘাটের ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল কাটোয়ায়।
বুধবার সন্ধ্যায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃদ্ধার দুই মেয়ে বিবাহিত। পাঁচ ছেলের এক জন মারা গিয়েছেন। বাকি চার জন গ্রামের অন্যত্র থাকেন। বেশ কয়েক বার ভাগীরথীর ভাঙনে বাড়ির কিছু অংশ তলিয়ে যাওয়ার পরেই তাঁরা সরে গিয়েছেন। বৃদ্ধা যেতে চাননি। ভিটে আঁকড়ে রয়ে গিয়েছেন। ভাগীরথীর তীরে চরণ পালের মন্দিরের পাশে তাঁর সেই বাড়িতে প্রতি বারই মেলার সময়ে আখড়ার লোকজন এসে ওঠে। এ বারও তারা ম্যারাপ বেঁধেছিল।
পরিবার সূত্রের খবর, মা আলাদা থাকলেও ছেলেরা পালা করে তাঁকে দেখাশোনা করতেন। মঙ্গলবার রাতে ৯টা নাগাদ এক ছেলে খাবার দিয়ে যান। বারান্দায় চৌকিতে শুয়েছিলেন বৃদ্ধা। এর পরে কী ঘটেছে কেউ জানে না। সকালে বাড়ি লাগোয়া শৌচাগার থেকে কয়েক হাত দূরে বাঁশগাছ ও কলাগাছের নীচে বৃদ্ধার দেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকার কয়েক জন। তাঁরাই বৃদ্ধার ছেলেদের খবর দেন।
বিষয়টি চাউর হতেই গ্রামবাসীরা এসে ভিড় করেন। বাড়িতে ডেরা গাড়া আখড়ার লোকজনকে চরণ পালের মন্দিরে আটকে রেখে মারধরও করা হয়। পড়শিদের বক্তব্য, রাতভর মাইক বাজছিল, জেনারেটর চলছিল। ফলে চিৎকার-চেঁচামেচি হয়ে থাকলেও তাঁরা কিছু শুনতে পাননি। বৃদ্ধার এক ছেলে বলেন, “সকাল সাড়ে সাতটার সময় আমরা খবর পাই। বাড়িতে ঢুকে দেখি, আখড়ার লোকজন পাততাড়ি গোটাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা কিছুই জানেন না। সন্দেহ হওয়ায় আমরা ওঁদের আটকে রাখি।” বৃদ্ধার ভাইপো বলেন, “আশপাশ দেখেই আমাদের ধারণা হয়েছে যে কাকিমাকে ধর্ষণ করে টানতে-টানতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পর ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়।”
খানিক বেলায় সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গোটা জায়গা লন্ডভন্ড। বাড়ি লাগোয়া কলাগাছে রক্তের দাগ। এসডিপিও (কাটোয়া) তন্ময় সরকার এবং কাটোয়া থানার ওসি জুলফিকার আলি ঘটনাস্থলে এসে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের সামনে দেহ আটকে রেখে বিক্ষোভও দেখান গ্রামবাসীরা। রাতে জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। সাত জনকে আটক করা হয়েছে। তবে এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।”