বর্ধমান শহরে... —নিজস্ব চিত্র।
বর্ধমান অতি সুপ্রাচীন শহর। ঐতিহ্যবাহী জনপদ। কতখানি প্রাচীন সে নিয়ে পণ্ডিতদের মতানৈক্য আছে। মহাবীর বর্ধমানের নামে নগরের নাম এমন কথাও বলা হয়েছে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমানের প্রশস্তি গেয়েছেন: 'দেখি পুরী বর্ধমান... /সুন্দর চৌদিকে চান /ধন্য বঙ্গ যে দেশে এ দেশ।' তাঁর দেখা বর্ধমান ছিল অধুনা দামোদরের পাড়ে। কাঞ্চননগর। উত্তরকালে ছুরি-কাঁচির জন্য যে স্থান ভূগোলে ঠাঁই পেয়েছে। পূর্বকালে দামোদর বেয়ে লাক্ষার বাণিজ্য হত। লাক্ষাডিহি বা লাখরডি, বর্তমানের লাকুরডি সেই সাক্ষ্য দেয়। এই দামোদর বেয়ে দ্বারকানাথের জাহাজ ভর্তি কয়লা যেত রাণিগঞ্জ থেকে কলকাতার কয়লাঘাটে।
মূল কথা, বর্ধমান একটি প্রাচীন, ক্রমবর্দ্ধমান ইতিহাসঋদ্ধ জনপদ। মুঘল সাম্রাজ্যের খুব বড়সড়ো সুবা বা প্রদেশ। সময়ে সময়ে নাম বদলে গিয়েছে পরগনার। সেলিমাবাদ, শরিফাবাদ, ইউসুফাবাদ। ভারতের ইতিহাসে ইন্দিরা গাঁধীর আগে অন্যতম ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নারীর নাম নুরজাহান। ইনি বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগানের সহধর্মিনী। তৎকালে নাম মেহেরুন্নেসা। বর্ধমানের কুলবধূ। ইতোপূর্বে সম্রাট আকবরের উদ্যোগে তাঁর প্রিয়ভাজন পীরবাহারাম শাক্কা সনাতন যোগী জয়পালের সঙ্গে সৌহার্দ্যের তীর্থ গড়ে তোলেন। কথিত আছে, হুমায়ুনের কাছে পরাজিত শেরশাহ বেশ কিছু দিন বর্ধমানে আত্মগোপন করেছিলেন।
১৬১০ নাগাদ লাহৌরের কোটলি মহল্লা থেকে তীর্থ পরিক্রমায় এসে সঙ্গম রায় নামের এক বণিক বর্ধমানে বাণিজ্যিক 'সম্ভাবনা' দেখে স্থায়ী ভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেন। ইনিই বর্ধমানের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সাবর্ণ রায়চৌধুরী ও জোব চার্নকের কলকাতা কেনাবেচার চুক্তি সম্পাদিত হয় বর্ধমানরাজের মধ্যস্থতায়। কলকাতায় হিন্দু কলেজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ টাকার অনুদান বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্রের। তিনি প্রচুর টাকা দেন আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার জন্য। তেজচন্দ্রের পুত্র প্রতাপচাঁদের ঐতিহাসিক মামলায় 'বিরূপ' সাক্ষ্যদান করে নাকি দ্বারকানাথ ভারতে প্রথম রেল কোম্পানি 'দ্য গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে' গড়ে তোলার অনুমোদন পান। মূলত দামোদরের ঝুঁকিপূর্ণ জল বেয়ে নয়, রেলপথে রাজমহল থেকে কয়লা আনার জন্য। আসল বা 'জাল প্রতাপচাঁদ' রাজ্য ফিরে পাননি। দ্বারকানাথও স্বপ্নের রেল দেখে যেতে পারেননি।
ভৌগোলিক ভাবে বর্ধমান শহরকে বলা হয় রাঢ়ের মধ্যমণি। এর পূর্ব দিকে চৈতন্যপদরজধন্য গঙ্গাতীরে কালনা-কাটোয়া বৈষ্ণবপদাবলীর পূতভূমি। দক্ষিণে মঙ্গলকাব্যের আঁতুড়ঘর। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল ঘনরাম-রূপরামের মনসামঙ্গল দামোদরের দক্ষিণ পাড়ে শতধারায় বিকশিত। পশ্চিম বর্ধমান দামোদর-বরাকরের অববাহিকা। কয়লা থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল। উত্তর বর্ধমান অজয় নদীর তীর ধরে কৃষিতে যেমন বিকশিত, কৃষ্টিতে আউল বাউল সাঁই দরবেশ এবং কবিরাজ জয়দেব গোস্বামীর বৈষ্ণব চিন্তনের উত্তরাধিকার। কৃষি-শিল্প (শিল্প বলতে এখানে আর্ট- ইন্ডাস্ট্রি দুটোই) বর্ধমান শহরকে ক্রমাগত পুষ্ট করেছে।
বর্ধমান পুরসভা —নিজস্ব চিত্র।
বর্ধমান শহরে বড় মাপের শিল্প না থাকলেও মূলত চালকল এবং ক্ষুদ্রশিল্প আছে। অন্য দিকে, শিল্প-সংস্কৃতিতে বর্ধমান শহর অত্যন্ত ঋদ্ধ। মহারাজ মহতাবচাঁদের উদ্যোগে হাজার উনিশ খণ্ডে (খিল হরিবংশ-সহ) মহাভারতের গদ্য অনুবাদ করা হয়। সাল-তারিখের নিরিখে কালীপ্রসন্ন সিংহের আগেও সম্ভবত এই অনুবাদ। বিখ্যাত শ্যামাসাধক এবং শ্যামা বিষয়ক গানের রচয়িতা কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের সাধনক্ষেত্র ও সৃজনক্ষেত্র বর্ধমান শহরের বোরহাট অঞ্চলে। বিজয়চাঁদ ছিলেন কৃতী নাট্যকার। তাঁর অর্থানুকুল্যে, পুত্র উদয়চাঁদের উদ্যোগে ১৯৩০-এ মফস্সল বাংলায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বরাতের ফের। বর্ধমানের রাজকুলে পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকের বিকাশ ঘটেছে অষ্টাদশ শতক থেকেই। এখানকার বেড় অঞ্চলের কামারবাড়ি ও কানাই নাটশালে নাটমঞ্চে নিয়মিত কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নাটক অভিনীত হত। পরে ভিক্টোরিয়া থিয়েটার, বিজয় থিয়েটার ইত্যাদি গড়ে ওঠে। প্রমোদীলাল ধৌন ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির ছাত্র। তাঁর ছাত্র সিনেমার দাপুটে 'রায়রায়ান' কমল মিত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কমল মিত্রের পিতামহ জগদ্বন্ধু মিত্র ১৮৯৪ দুই খেপে বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। কমল মিত্রের পিতা নরেশচন্দ্র মিত্রও উত্তরকালে চেয়ারম্যান হন। কমল মিত্র বর্ধমান পুরসভার চেয়ারম্যান হননি। তবে, রুপোলি পর্দায় একাধিক রাগি চেয়ারম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এর ১১ বছর আগে ১৮৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্ধমান পুরসভা! পুরএলাকা ২৬.৩০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার। বেসরকারি হিসাব মতো প্রতিদিন চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি এবং আরও নানা কাজে প্রতি দিন শহরে আসেন আরও প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ। এরমধ্যে চিকিৎসা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
এক সময় বলা হত, বর্ধমান শহরে শুধু খোশবাগান এলাকায় যত ডাক্তার আছেন তত ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আর কোথাও নেই। পাশাপাশি বিজয়চাঁদ রোড থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত অথবা দক্ষিণে অর্ধচন্দ্রাকারে বিজয়চাঁদ রোড পর্যন্ত শুধু ডাক্তার আর ডাক্তার। বিজয়চাঁদ হাসপাতাল এবং তার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল অনাময় প্রায় চারটি জেলার স্বাস্থ্যপরিষেবা দিয়ে থাকে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজও রাজ্যের কলেজগুলির পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমের সংখ্যা প্রায় ২০০। কলকাতার নামী চিকিৎসকেরা বর্ধমানে নিয়মিত যাতায়াত করেন।
বর্ধমান শহর একটি বিশেষ বাণিজ্য কেন্দ্র । ফুটপাতের ব্যবসায়ী থেকে বড় বড় শপিং মল গমগম করে। কৃষিভূমি বর্ধমানের নানা প্রান্ত থেকে আসে শাকসব্জি। অন্য অনেক নগরীর থেকে এখানকার কৃষিপণ্য যথেষ্ট কম দামে পাওয়া যায়। যে কোন কারণে হোক, গ্রাম-গ্রামান্তরে থেকে আগত ক্রেতা ও বিক্রেতা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমলের থেকে ফুটপাতে মুক্তকণ্ঠ দামদস্তুর করতে অনেক স্বচ্ছন্দ।
লর্ড কার্জনের বর্ধমান আগমন উপলক্ষে তৈরি হয়েছিল স্টার অব ইন্ডিয়া গেট। যা সাধারণ্যে কার্জন গেট নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, এই উপলক্ষে বর্ধমানের প্রখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ভৈরব নাগ তৈরি করেছিলেন সীতাভোগ মিহিদানা। স্টার অব ইন্ডিয়া গেট থেকে বর্ধমানের রাজবাটি মহতাবমঞ্জিল একটি সুদীর্ঘ সরলরেখা। দু'পাশে অসংখ্য বিপনী। কোথাও পর পর সোনার দোকান। কোথাও শাকসব্জির। বর্ধমান শহরের মূল রাস্তা দিয়ে যেতে হলে কার্জন গেট অতিক্রম করতেই হবে। 'কার্জন গেট' নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বঙ্গভঙ্গের ভিলেন কার্জন নামাঙ্কিত তোরণের ভিতর দিয়ে যেতে রাজি হননি তরুণ সুভাষ। অনেকখানি ঘুরে গিয়েছিলেন। মহাজনটুলি নামক পল্লিতে স্থানে স্থানে বারাঙ্গনাদের অধিরাজ্য। আদত নাম জেবি মিত্র লেন।
রাজবাড়ি বর্তমানে বর্ধমানের প্রশাসনিক ভবন। মহাতাব রোডে গড়ে উঠেছে সুবর্ণজয়ন্তী ভবন। গোলাপবাগে প্রায় সব বিভাগের পাঠকেন্দ্র। এই শহরে সরকারি-বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের সংখ্যা চার। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, নার্সিং কলেজ, বিএড কলেজ প্রায় এক ডজন। শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্ধমান শহর একটি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। সরকারি-বেসরকারি, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলে শহরে প্রায় পঞ্চাশটির মত ছোট-বড় বিদ্যালয়। দেড় বছর করোনার কারণে বেশ কিছু স্কুল সংকটসঙ্কুল।
বর্ধমানের মিশ্র জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ দিন সৌহার্দ্যপূর্ণ বাতাবরণ বর্তমান। মন্দির মসজিদ গির্জা ( ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট) এখানে পাশাপাশি। খাগড়া গড়ের অনভিপ্রেত 'ঘটনা' বাদ দিলে এখানে সাম্প্রদায়িক হানাহানি কখনওই হয়নি। সব জনগোষ্ঠী কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন সংকটে এবং সংযমে।
বর্ধমান পুরসভার প্রতিষ্ঠাকালে প্রথম পুরপতি ছিলেন মন্টেসর। ১৮৭৮ মনোনীত পুরপতি জগদ্বন্ধু মিত্র। ১৮৮৪ তে নলিনাক্ষ বসু। বাইশ বছর ধরে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। শহরে জল-কল চালু করেন। পুরকরের সূচনা করেন। ১৯১১-য় পুরপতি হন সন্তোষকুমার বসু। ষোলো বছর তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। জওহরলাল নেহরু তার বাড়িতে সকন্যা আসেন। তাঁর সময় কালে বর্ধমানের পুর এলাকায় বিদ্যুৎ আসে। রবীন্দ্রনাথকে বর্ধমানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন দেবপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। প্রতিষ্ঠ আইনজীবী সন্তোষ বসু সঙ্গে পেয়েছিলেন উপ পুরপতি হিসেবে নাজির হোসেন এবং পরে মোহাম্মদ আজিমকে।
রাস্তায় প্রথম আলো জ্বালান মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন। পাকা রাস্তা, নর্দমা, শুদ্ধ পানীয় জল এনে দেন নরেশ মিত্র। বিখ্যাত অভিনেতা কমল মিত্রের বাবা। ১৯৩৭ এ গিরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ।১৯৪৬-এর পুরপতিকে নিয়ে বর্ধমানের কৌতুক অভিনেতা নবদ্বীপ হালদারের বিখ্যাত উক্তি, 'সে কি মশাই, টোগো সরকারের নাম জানেন না!’ পরবর্তী কালে পুরপতি পদে এসেছেন তারাকুমার-রুদ্রনাথ-কিরীটি-ফণিভূষণ দু-চার মাসের জন্য। বাহাত্তরে তারা প্রামাণিক, ছিয়াত্তরে সাধন ঘোষ, একাশিতে সুধাংশু রায়, পরে কুড়ি বছর সুরেন মণ্ডল ছিলেন পুরপতি। বাম জমানায় শেষ পুরপতি আইনুল হক। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুরপতি হলেন চিকিৎসক স্বরূপ দত্ত। অতঃপর দু'বছর প্রশাসনিক প্রশাসক। চার পাঁচ মাস আগে রাজনৈতিক প্রশাসক। পুরপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় আপাতত সিবিআই তদন্তে। কাজ সামলান বাম জমানায় শেষ পৌরপতি আইনুল হক। অধুনা তৃণমূলে।
মনোনীত থেকে নির্বাচিত। দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে এই পুরসভা নানাবিধ কাজ করে চলেছে। দল বদলেছে। মত বদলেছে। বর্ধমান কিন্তু ক্রমবর্ধমান।
২৭ ফেব্রুয়ারি পুরসভার নির্বাচন। নাগরিকরা অপেক্ষমান। নির্বাচিত বোর্ড আসুক।
বর্ধমান বেড়ে চলুক।