অর্থ কমিশনের টাকা খরচ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। প্রতীকী চিত্র।
চলতি আর্থিক বছরে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের টাকা এখনও জেলায় এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু শেষ দু’টি আর্থিক বছরে (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওনা টাকা এখনও খরচ করে উঠতে পারেনি পূর্ব বর্ধমান জেলা। তার জেরে জেলার খাতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত মিলিয়ে ডিসেম্বরের শেষে একশো কোটির বেশি টাকা পড়ে রয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে উন্নয়নের টাকা কেন পড়ে থাকবে, সে নিয়ে নভেম্বরের গোড়ায় কাটোয়ায় দলের সভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথই। উন্নয়নের টাকা পড়ে থাকায় কটাক্ষ করছে বিরোধীরাও।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের রিপোর্ট অনুযায়ী— পূর্ব বর্ধমানে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন থেকে গত দু’টি আর্থিক বছরে ২১৫টি পঞ্চায়েত ৩৩৫ কোটি ৪ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকা পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৭৭ কোটি ৪১ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা (৮৩%)। অর্থাৎ, হাতে রয়েছে প্রায় ৫৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। জেলার ২৩টি পঞ্চায়েত সমিতিতেও ১৬ কোটি ১৮ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা পড়ে রয়েছে। তারা পেয়েছিল ৬৯ কোটি ৭৭ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা। খরচ করেছে ৫৩ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা (৭৬.৮১%)। আর জেলা পরিষদ পেয়েছিল ৭৩ কোটি ৬৬ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। এখন সেখানে পড়ে রয়েছে ৩৪ কোটি ৫৬ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ৩৯ কোটি ১০ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা (৫৩.০৮%)। তিনটি স্তরে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন থেকে জেলা পেয়েছিল ৪৭৮ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ৩৭০ কোটি ১১ লক্ষ টাকা (৭৭.৩৪%)। পড়ে রয়েছে ২২ শতাংশের বেশি টাকা।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) কাজল রায়ের দাবি, “চলতি আর্থিক বছরের টাকা এখনও জেলায় আসেনি। গত দু’টি আর্থিক বছরে পড়ে থাকা টাকা জানুয়ারির মধ্যেই খরচেরার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সে জন্য প্রতিটি মহকুমা ধরে সংশ্লিষ্ট প্রধানদের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করা হয়েছে।’’ তাঁর সংযোজন, “খরচের দিক থেকে পূর্ব বর্ধমান রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।’’ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ওই বৈঠকগুলিতে ১২টি পঞ্চায়েতকে সতর্ক করেছে জেলা প্রশাসন। রিপোর্ট অনুযায়ী, পানীয় জল সরবরাহে ছ’টি পঞ্চায়েত, জনস্বাস্থ্যে চারটি, রাস্তা তৈরিতে দু’টি পঞ্চায়েত কোনও টাকা খরচ করতে পারেনি। প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, সেপ্টেম্বরের বৈঠকের পরে গত পাঁচ মাসে জেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, একটি বছরে অর্থ কমিশনের মোট বরাদ্দের ৭০% পায় পঞ্চায়েত। ১৫% করে পায় পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। মোট টাকার ৬০% পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, শৌচালয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো নির্ধারিত কিছু খাতে খরচ হয় (টায়েড ফান্ড)। বাকি ৪০% খরচ হয় রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ছোট সেতু তৈরি বা মেরামত, আলোর মতো বিভিন্ন খাতে (আনটায়েড ফান্ড)। জেলা পরিষদ ‘টায়েড ফান্ড’-এ মাত্র ২৬.২৩% টাকা খরচ করেছে। সেখানে ‘আনটায়েড ফান্ড’-এ ৮৩% টাকা খরচ করে ফেলেছে। পঞ্চায়েত সমিতির স্তরে দু’টি ক্ষেত্রেই ৭৫% টাকা খরচ হয়েছে। আবার পঞ্চায়েত স্তরে ‘টায়েড ফান্ড’ ৭৮.৩৮%, ‘আনটায়েড ফান্ড’ ৮৭.০১% খরচ হয়েছে। জেলা পরিষদ সভাধিপতি শম্পা ধাড়া বলেন, “টায়েড ফান্ডের টাকায় জেলা পরিষদ ৫৩০টি সৌর পাম্প বসাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর কাজটি করছে। জানুয়ারিতেই শেষ হয়ে যাবে।’’
রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘আনটায়েড ফান্ড’ থেকে রাস্তা তৈরির কাজে পিছিয়ে রয়েছে পঞ্চায়েত সমিতিগুলি। এই কাজে বরাদ্দ হয়েছিল ৩২ কোটি ২২ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ৩৮.১১%। পঞ্চায়েত পেয়েছিল ১৫৬ কোটি। খরচ করেছে ৬১.৩১%। সেখানে জেলা পরিষদ ৮২.৪০% টাকা খরচ করেছে। আবার, পানীয় জল প্রকল্পে জেলা পরিষদ মাত্র ১২.৪৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। তহবিলে পড়ে রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। গোটা জেলায় পানীয় জলের জন্য ৫২.৩৯% টাকা খরচ হয়েছে। পড়ে রয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। জনস্বাস্থ্যে জেলায় ৮৬.০৩% টাকা খরচ হয়েছে। তার পরেও প্রায় ১৮ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। অনেক পঞ্চায়েত কর্তার দাবি, বাড়ি-বাড়ি পানীয় জলের বিশেষ সংযোগ দেওয়া ও স্বচ্ছ ভারত মিশন থেকে নানা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। সে কারণে একই জায়গায় দু’টি খাতের টাকা খরচ করা হচ্ছে না। তাই পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের ওই খাতের টাকা পড়ে থাকছে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, কাটোয়ায় এক বৈঠকে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ পঞ্চায়েত ভোটের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “সব টাকা খরচ হয়নি। মমতাদি (মুখ্যমন্ত্রী) উন্নয়নের টাকা ফেলে রাখা যাবে না বলেছেন। প্রধানেরা বিষয়টি দেখুন। পঞ্চায়েত নির্বাচন তো করতে হবে!” বিজেপি নেতা সৌম্যরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “উন্নয়নে যে তৃণমূল মন দেয় না, গ্রামীণ স্তরে টাকা পড়ে থাকা সেটাই প্রমাণ করে।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতেই ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।’’