মেমারি থানায় ক্ষতিপূরণ না পেয়ে বিক্ষোভ চাষিদের। —নিজস্ব চিত্র।
শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের সরকারি ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন চাষিরা। জেলার চাষিদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের তালিকায় প্রকৃত চাষিদের নাম নেই। তার জায়গায় বোরো চাষ করেননি এমন অনেক জমির মালিকের নাম রয়েছে। কৃষি দফতর থেকে তাঁরা ক্ষতিপূরণের চেকও পেয়ে গিয়েছেন বলে চাষিদের দাবি। আবার জমির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বেশি করে ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠছে। ক্ষতিপূরণের তালিকায় ভুয়ো চাষি রয়েছে মুখ্যামন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন শাসকদলের একাংশ নেতাও। বিরোধী নেতাদেরও ধারনা, ক্ষতিপূরণ নিয়ে দলবাজি ও দূর্নীতির কারণেই গ্রামে গ্রামে চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে চাষিদের হাতে আক্রান্তও হচ্ছেন শাসকদলের নেতারা।
দিন চারেক আগে মেমারির তৃণমূল নেতা অরবিন্দ হুঁইকে বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিলেন বেগুটি গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামবাসীরাই জানান, ওই তৃণমূল নেতা-সহ ৮ জন মিলে গ্রামের বারোয়ারিতলায় বসে ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করছিলেন। তালিকা প্রকাশ পেতেই ক্ষোভ ছড়াতে থাকে গ্রামে। এরপরেই বাড়ি থেকে তুলে এনে চাষিরা চড়া রোদের মধ্যে তিন ঘন্টা আটকে রাখেন ওই নেতাকে। এমনকী পুলিশও উদ্ধার করতে গেলে বিক্ষোভের মুখে পড়ে বলে অভিযোগ। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মেমারি থানার পুলিশ তালিকায় দুর্নীতির অভিযোগে ওই নেতাকে গ্রেফতার করে। আপাতত জেল হেফাজতে রয়েছেন তিনি। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, প্রান্তিক চাষিরা ক্ষতিপূরণ পাননি, অথচ চাষ করেনি এমন জমির মালিকরা মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তালিকায় এমনটা দেখেই ক্ষোভ ছড়িয়েছিল বলে চাষিদের দাবি। এ ছাড়া ওই তৃণমূল নেতা প্রকাশ্যে স্বীকারও করে নিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আরও সাত তৃণমূল নেতা ক্ষতিপূরণের টাকা ভাগ করে নিয়েছেন। গ্রামবাসীরা ওই সাত নেতার নামেও পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁদের অবশ্য পুলিশ এখনও গ্রেফতার করেনি।
মেমারির ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে শাসকদল। বর্ধমান ১ ব্লকের রায়ান ২ পঞ্চায়েতের জামাড় গ্রামের তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য শেখ আসপিয়া, সুজাতা মল্লিক, বর্ধমান ১ পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ সঞ্জয় কোনার ও স্থানীয় বুথ কমিটির তৃণমূল নেতা নারায়ণচন্দ্র দাস লিখিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, গত ২২ জুলাই ব্লকের কৃষি আধিকারিকের সামনে শিলাবৃষ্টিতে বোরো চাষে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের চেক দেওয়া হয়। সেখানে দেখা গিয়েছে, প্রকৃত গরিব চাষিরা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের দাবি, প্রকৃত চাষিদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া এবং ভুয়ো চাষিদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। একই মর্মে জামাড় গ্রামের কৃষকেরাও মুখ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী-সহ বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছেন। চাষিদের চিঠিটির উপর ‘ঘটনাটি সত্য’ বলে লিখে দিয়েছেন তৃণমূলের ওই পঞ্চায়েত সদস্যেরা। খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়ে চিঠিতে সাক্ষরও করেছেন। তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য শেখ আসপিয়ার অভিযোগ, ‘‘এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়নি। চাষিদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না আমরা।’’
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার ৫৫৫টি মৌজায় শিলাবৃষ্টির জেরে বোরো ধানে ক্ষতি হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী মেমারি ২ ব্লকের বড়পলাশন ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি মৌজাতে মাত্র এক জন চাষি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে মেমারি ২ ব্লকের দেবীপুর পঞ্চায়েতের একটি মৌজা। সেখানে ২০২ জন চাষি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। চাষিদের অভিযোগ, কৃষি দফতরের বদলে তৃণমূলের নেতারা গ্রামের বারোয়ারিতলায় বসে তালিকা তৈরি করেছেন। তারপরে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তা কৃষি দফতরে গিয়েছে। কিন্তু কৃষি দফতরের কোনও আধিকারিক বা কর্মী গ্রামে এসে সেই তালিকা খতিয়ে দেখেননি। বিষয়টি মেনে নিয়েছেন কৃষি দফতরের কর্তারাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা বলেন, “আমাদের হাতে পরিকাঠামো নেই। প্রতিটি পঞ্চায়েতে কেপিএস নেই। এ অবস্থায় পঞ্চায়েতের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছে।’’ তাঁদের দাবি, ‘‘গ্রাম পঞ্চায়েত তো সরকারেরই একটা অংশ।”
তবে বর্ধমান জেলা কৃষক সভার অভিযোগ, এক জনই হোক বা ২০২ জন, এই চাষিরা কারা অথবা চাষিরা কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেল তার কোনও তালিকা কৃষি দফতর প্রকাশ্যে আনছে না। এমনকী তথ্য জানার অধিকার আইনেও ওই তালিকা দিতে প্রশাসন গড়িমসি করছে। কৃষক সভার বর্ধমান জেলার সম্পাদক আব্দার রেজ্জাক মণ্ডলের আশঙ্কা, “ওই তালিকা প্রকাশ হলে প্রতিটি গ্রামেই মেমারির মত ঘটনা ঘটবে। আমাদের ধারণা, ওই তালিকায় অন্তত ৬০ শতাংশ ভুয়ো চাষির নাম রয়েছে অথবা শাসকদলের আনুগতদের নাম রাখা হয়েছে।”
বর্ধমানের জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু অবশ্য বলেন, “ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। স্থানীয় বিডিওরা সরাসরি ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা চাই না, ক্ষতিগ্রস্থ কোনও চাষি ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হোক।”