বিজড়ায় শোকার্ত পরিবার। নিজস্ব চিত্র।
বাড়ির মধ্যে সকলেই খোশমেজাজে ছিলেন। আচমকা রাত ৮টায় একটা ফোন এল।
মুহূর্তের মধ্যে বুকফাটা কান্নার আওয়াজে বাড়ির ছবিটা বদলে গেল। আর সামলাতে পারলেন না বাড়ির কর্তা। তাঁকে ভর্তি করানো হল হাসপাতালে।
শনিবার সন্ধ্যায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের কাছে মেমারি থানার পালশিটে পথ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুর পর এমনই শোকের ছবি বিজড়া গ্রামের মণ্ডল বাড়িতে।
পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ওই সন্ধ্যায় বিজড়ার বাসিন্দা রফিক মণ্ডল (৩০), তাঁর স্ত্রী সেরিনা (২৪) ও দুই সন্তান সাইনা ও শাহিদকে নিয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। আচমকা কলকাতামুখী পাথর বোঝাই একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে ওই চারজনকে পিষে দেয়। তারপর অশোক লায়েক (৩৫) নামে এক সাইকেল আরোহীকেও ধাক্কা মেরে উল্টে যায় গাড়িটি। ঘটনাস্থলেই মারা যান পাঁচ জন। পেশায় কাগজ কলের কর্মী অশোকবাবুর বাড়ি বর্ধমান থানার ভাণ্ডারডিহি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি সেই সময় শক্তিগড় স্টেশন থেকে সাইকেলে করে কাগজ কলে যাচ্ছিলেন।
পাঁচ জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে গভীর রাতে অগ্রদ্বীপে গোপীনাথের আখড়া থেকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছন তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ। সেখান থেকে নিহতের পরিজনদের সঙ্গে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও আসেন।
বাড়ির বড় ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি মারা গিয়েছে, এই খবর পেয়ে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি রফিকের বাবা আব্দুল্লা মণ্ডল। তাঁকে প্রথমে মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে ভর্তি করানো হয় বর্ধমান মেডিক্যালে। রাতে সেখানেই ছিলেন। রবিবার সকালে বাড়ি ফেরেন প্রিয় মানুষগুলোকে শেষ বার চোখের দেখা দেখতে।
বিজড়া গ্রামের মণ্ডল বাড়ির সামনে তখন কয়েকশো মানুষের ভিড়। বাড়ির দুয়ারে ভেঙে পড়েছে গোটা গ্রাম। বাড়ির লোকজন জানান, বর্ধমানে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে জামালপুরের উচিতপুরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন রফিক। সেখান থেকে পরিচিতজনদের মোটরবাইকে করে পালশিটের ওই এলাকায় বাস ধরার দজন্য অপেক্ষা করছিলেন।
চাষাবাদ করেই দিন গুজরান করতেন তিনি। পরিজনেরা জানান, এলাকার কারও বিপদ-আপদের খবর পেলেই ছুটে যেতেন রফিক। শেখ আবুল নামে মণ্ডল বাড়ির পরিচিত এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘রাত ৮টা নাগাদ গ্রামের এক জনকে পুলিশ দুর্ঘটনার খবরটা দেয়। তারপর থেকে কেবলই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ও বাড়ি থেকে।’’
রফিকা বিবি বড় ছেলে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না। কখনও আত্মীয়দের দিকে, কখনও বা বাড়ির দেওয়ালের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন তিনি।
এক পড়শি জানান, এই তো বছর কয়েক আগেই মাটির বাড়ির কাঠামো বদলে ইটের গাঁথনি উঠেছিল। এখনও ইটের গায়ে পলেস্তরারও প্রলেপ পড়েনি।
রফিকা বিবির দিকে চেয়ে এক পড়শি আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বলে ফেলেন, ‘‘ও যেন এখনও নাতি-নাতনি খুঁজে চলেছে।”