TMC

পরাঠা-পরোটা, সওরভ-সৌরভ: ফ্লেক্স প্রচার শহর জুড়ে! ‘তৃণমূলের উস্কানি’ দেখছে বিজেপি

এই ফ্লেক্স প্রচারের নেপথ্যে তৃণমূলের হাত রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:৩০
Share:

কলকাতা জুড়ে কারা ঝোলালেন এই সব ফ্লেক্স, জল্পনা রয়েছে তা নিয়ে। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

রাজনীতির মাঠে বড়সড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার চেষ্টায় ভাষা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ধাক্কা খেয়ে কিছুটা টালমাটাল তৃণমূল। কিন্তু হারানো জনভিত্তি নিত্যনতুন কৌশলে পুনরুদ্ধারেও মরিয়া বাংলার শাসক দল। উল্টো দিকে বিজেপি-ও বাংলার ক্ষমতার অলিন্দে নিজেদের ভাগ-বাঁটোয়ারা বুঝে নিতে তৎপর। এই তুমুল টানাপড়েনের মঞ্চে আচমকা হইহই করে হাজির হয়েছে বাংলা ভাষা। কারা যেন কলকাতা জুড়ে এক বিশেষ ধরনের ফ্লেক্স ঝোলাতে শুরু করেছেন। বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে— বাংলা ভাষা বিপন্ন। বিভেদ তৈরি করার মরিয়া চেষ্টায় তৃণমূল— বলছে বিজেপি।

Advertisement

মূলত সাদা এবং মেরুন রঙে ছাপানো ফ্লেক্স। একই মাপ, একই রকম নকশা। তাতে লেখা ‘পরাঠা থেকে পরোটা ভাল’। বা ‘সওরভ থেকে সৌরভ ভাল’। বা ‘বঙ্গাল থেকে বাংলা ভাল’। বা ‘স্বচ্ছ্‌ ভারত থেকে পরিচ্ছন্ন ভারত ভাল’।

গোটা কলকাতা তো বটেই, শহরের উত্তর এবং দক্ষিণের বিস্তীর্ণ শহরতলিও ছেয়ে গিয়েছে এই সব ফ্লেক্সে। কারা ছাপালেন? ফ্লেক্সগুলোয় কোনও সুলুক-সন্ধান নেই। শুধু ফ্লেক্সের নীচের দিকে লেখা হয়েছে, ‘ভালো ভাষা’ এবং ‘নিজের ভাষা নিজের থাক’।

Advertisement

এই ঘটনার নেপথ্য তৃণমূলই রয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপির। —নিজস্ব চিত্র।

বিজেপি নেতারা বলছেন, ভাষা নিয়ে ‘অশান্তি’ লাগাতে চাইছে তৃণমূল। রাজ্য বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা মনে করছেন, প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শেই তৃণমূল এই নতুন ‘হাওয়া তোলা’র চেষ্টা শুরু করেছে। তবে তৃণমূল সরাসরি করছে না, ‘বাংলা পক্ষ’ নামে একটি সংগঠনকে দিয়ে এই ‘ফ্লেক্স ক্যাম্পেন’ চালানো হচ্ছে বলে গেরুয়া শিবিরের দাবি।

কাদের সংগঠন এই ‘বাংলা পক্ষ’? এই সংগঠনের মাথায় রয়েছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যের নানা প্রান্তে সভা, মিছিল, বিক্ষোভ-সহ নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি এ রাজ্যে বিপন্ন— গর্গর অধিকাংশ ভাষণের মূল কথা এই রকমই। বিভিন্ন সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলেও প্যানেলিস্ট হিসেবে কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে। আর রাজনৈতিক ভাবে তাঁর পরিচয় তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হিসেবেই। বিজেপি-কে যে তিনি একদম পছন্দ করেন না এবং ওই দলকে যে ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’-এর প্রতীক হিসেবে দেখেন গর্গ, তা-ও তিনি সর্বত্র খোলাখুলিই বলেন।

আরও পড়ুন: শঙ্খ ঘোষদের ডি-লিট দেবে যাদবপুর, প্রথমে আপত্তি জানিয়েও পরে মেনে নিলেন আচার্য

অতএব বিজেপি নেতারা সরাসরি আঙুল তুলতে শুরু করেছেন গর্গ এবং তাঁর সংগঠনের দিকে। এই সব ফ্লেক্স ছাপানো এবং ছড়ানোর পিছনে তিনি বা তাঁর ‘বাংলা পক্ষ’ রয়েছে কি? গর্গ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। হ্যাঁ বা না— কিছুই বলেননি। তবে এই অভিনব প্রচারাভিযানের বিষয়বস্তুকে পুরোপুরি সমর্থন করছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা ভাষাকে যে ভাবে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে, তাতে এই ধরনের প্রচারাভিযান এখন খুব জরুরি।’’

কিন্তু পুঁজি বা বাজারে অবাঙালিদের আধিপত্যের সঙ্গে ভাষার উপরে আঘাত আসা বা ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়ার কী সম্পর্ক? গর্গের ব্যাখ্যা, ‘‘বাজার, জমি, চাকরি— সব কিছু অবাঙালিদের দখলে চলে যাচ্ছে। পুঁজি তাদের হাতে। মনে রাখবেন, পুঁজি এবং আধিপত্য যাঁদের হাতে, তাঁদেরকেই অন্যরা অনুকরণ করতে চান। সৌরভ না বলে অনেক বাঙালি আজকাল সওরভ বলেন বা পরোটা না বলে পরাঠা বলেন।’’

লক্ষ্যনীয় হল গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া এই উদাহরণ। যে ‘সওরভ’ বা যে ‘পরাঠা’র কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলেন তিনি, ঠিক সেগুলোই উঠে এসেছে শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ফ্লেক্সগুলোতে।

কলকাতার বিভিন্ন অংশেই দেখা যাচ্ছে এই ধরনের ফ্লেক্স। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

রাজনৈতিক স্বার্থে হোক বা অন্য কোনও কারণে, তৃণমূল কিন্তু বাঙালির বা বাংলার বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বেশ কিছু দিন ধরেই সরব। তাই শহরের আনাচে-কানাচে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে ফ্লেক্স পড়তেই তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছে প্রতিপক্ষ শিবির।

এই ফ্লেক্স প্রচারের নেপথ্যে তৃণমূলের হাত রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বহিরাগত— এমন একটা কথা তৃণমূল অনেক দিন ধরেই বলার চেষ্টা করছে। এর আগে, বাংলায় মূল লড়াই যখন ছিল কংগ্রেস আর বামেদের মধ্যে, তখনও ‘বাংলার সঙ্গে বঞ্চনা’ তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা হত। ওই প্রচারের মাধ্যমে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে বিঁধতে চাইত রাজ্যের শাসক বামেরা। কিন্তু ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব খাড়া করা কারও পক্ষেই সম্ভব হত না। কারণ স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের প্রায় সর্বত্র কংগ্রেসের অস্তিত্ব ছিল। বাংলাও তার বাইরে ছিল না। আর বামেদের উত্থান যে রাজ্যগুলি থেকে, তার মধ্যে বাংলা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। বাম-কংগ্রেস অনেক দুর্বল। মূল লড়াই এখন তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে। তৃণমূল এ রাজ্যের দল হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু বিজেপির প্রভাব বাংলায় নতুন। তাই বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ এবং ‘হিন্দি বলয়ের দল’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না প্রতিপক্ষ।

শহরের সব প্রান্তেই এমন দৃশ্য। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: ফের বিস্ফোরক রাজ্যপাল, রাজ্যের তিন মন্ত্রীকে প্রকাশ্যে তোপ​

বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ জাগিয়ে তোলার যে চেষ্টা হচ্ছে, তা যদি সফল হয়, তা হলে ভোটের হিসেব আবার নতুন করে কষতে হতে পারে। মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের। সে কথা সম্ভবত বিজেপি নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন। বুঝতে পারছেন বলেই, এই অভিনব প্রচারাভিযানের কড়া নিন্দা করছেন। তবে মন্তব্য করার সময়ে খুব সতর্কও থাকছেন।

সে সতর্কতা কী রকম? এক দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করে তোলার পাল্টা অভিযোগ তুলছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তার সঙ্গেই আবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন, বিখ্যাত বাঙালিদের নিয়ে বিজেপি কতটা গর্ব বোধ করে।

দিলীপ ঘোষ আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উপরে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল উর্দু শিবির থেকে। গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধ লড়তে হয়েছিল উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রেলমন্ত্রী হলেন, তখন স্টেশনের নাম উর্দুতে লেখানোর ব্যবস্থা করলেন। কলকাতা পুরসভা যে সব বোর্ডে রাস্তার নাম লেখে, সেখানে উর্দুতে লেখা শুরু হল।’’ বাংলা ভাষাকেও মমতা বিকৃত করেছেন বলে রাজ্য বিজেপির সভাপতির দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রামধনু বলবেন না, রংধনু। আকাশি বলবেন না, আসমানি। বাংলার বদলে উর্দু শব্দ চলে এল। আম্মা, আব্বা, আপা— এই সব নানা উর্দু শব্দ বাংলা পাঠ্যবইতে আমদানি করলেন। বাংলার উপরে আঘাতটা কে হানছেন, বুঝতে বাকি থাকে না।’’

এর পরেই বাঙালি অস্মিতাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘বাঙালি চিরকাল গোটা বিশ্বকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দকে গোটা বিশ্ব চিনেছে। ভারতের মধ্যে বাংলাই সবচেয়ে বেশি নোবেল পেয়েছে। সেই বাঙালিকে শুধু বাংলা ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা যাঁরা করেন, তাঁরা সঙ্কীর্ণ।’’

রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও আক্রমণাত্মক। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল চাইছে একটা অশান্তি লাগাতে। কিছুতেই বিজেপির অগ্রগতি থামাতে পারছে না। তাই ভাষার ভিত্তিতে একটা বিভাজন করে দিতে চাইছে। অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে ভোটে জিততে চাইছে।’’

তৃণমূল অবশ্য বলছে, এই প্রচারাভিযানের সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই। দলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘বিজেপি খুব ভয় পায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এতই ভয় পায় যে, আজকাল মনে হয় স্বপ্নেও তৃণমূলের ভূত দেখে। সেই দল এই সব ফ্লেক্সেও তৃণমূলের ভূত দেখবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?’’

রাজ্যের আর এক মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস আবার বোঝাতে চাইলেন যে, বিজেপির এই অভিযোগকে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি নেতাদের এই ধরনের প্রচারের বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করব না। এদের বলতে দিন। এঁরা যত এ সব বলবেন, ততই আমাদের ভাল হবে।’’

শহর জুড়ে এই ফ্লেক্স প্রচারের সঙ্গে তৃণমূল সরাসরি যুক্ত, এমন কোনও পাথুরে প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে দৃশ্যদূষণের কথা বলে পুরসভা যে বিভিন্ন ফ্লেক্স-ব্যানার সরিয়ে দেয়, এই সব ফ্লেক্সের ক্ষেত্রে তেমনটাও ঘটেনি।

আরও পড়ুন: কাছ থেকে পর পর গুলি! নিজের অফিসেই খুন হিন্দু মহাসভার প্রাক্তন নেতা​

ঘাসফুল শিবিরের প্রশ্ন, ফ্লেক্সগুলোয় তো কোনও রাজনৈতিক দলকে নাম আক্রমণ করা হয়নি। বিজেপি কেন এত চটে যাচ্ছে? বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘স্বচ্ছ্‌ ভারত’ কথাটাকে যে ভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে, তাতে কি আক্রমণের লক্ষ্য বুঝতে বাকি থাকে?

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা এবং বাঙালির বিপন্নতা নিয়ে প্রচার এই প্রথম বার দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। আশির দশকের শেষ দিকে বা নব্বইয়ের দশকে ভাষা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। বাঙালি সুশীল সমাজের খুব বড় বড় এবং প্রভাবশালী নাম সেই সব আন্দোলনে এক সময়ে শামিল হয়েছেন। সব দোকানে বাংলায় লেখা হোর্ডিং বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা হয়েছে। ইংরেজি বা হিন্দিতে লেখা হোর্ডিঙে কালি লেপে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোটা বাংলা জুড়ে সেই আন্দোলন ঝড় তুলে দিতে পারেনি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই সময়ে বাংলা ভাষাকে নিয়ে যা কিছু হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ ছিল না। কিন্তু এ বার যা হচ্ছে, তাতে রাজনীতির ইন্ধন রয়েছে এবং এই জল অনেক দূর গড়াতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের অনেকেরই।

ইতিমধ্যেই বাংলার নানা এলাকা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাক্ষী হয়ে গিয়েছে। এ বার বাংলা ভাষা নিয়ে যে হইচই শুরু হল, কতটা তুঙ্গে উঠবে, এখনই বলা কঠিন। কিন্তু আবেগ বা অস্মিতা জাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে বাংলাকে যে আরও একটা মেরুকরণের মুখে দাঁড়াতে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের সংশয় কমই।

বাংলা ভাষা, তার ব্যবহার ও রাজনীতি— আপনাদের কোনও মন্তব্য আছে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement