অস্ত্রোপচারের পরে কানাই পতিহার। নিজস্ব চিত্র
পরিকাঠামো ছিল। তবু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে সাফল্য ছিল অধরা। সেই সব ঘাটতিকে পিছনে ফেলে সম্পূর্ণ নিখরচায় মস্তিষ্কের জটিল অস্ত্রোপচারে কানাই পতিহারদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (বিআইএন)।
ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা, বছর ষাটের কানাইবাবু মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যে-ভাবে ওই রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, চিকিৎসকদের পরিভাষায় তার নাম ‘সাব অ্যারাকনয়েড হেমারেজ’। এ-সব ক্ষেত্রে রক্তনালির যে-অংশ ফেটে বিপত্তি ঘটে, সেটি বেলুনের (অ্যানিউরিজ়ম) আকার নেয়। অস্ত্রোপচারে ক্ষতস্থান সারালেও নতুন কোথাও ফাটল ধরে রক্ত বেরোতে থাকে। চিকিৎসকেরা জানান, এর জেরে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ‘‘অস্ত্রোপচারের সাহায্যে ক্ষতস্থান সারিয়ে তোলা খুব ঝুঁকির। মস্তিষ্কের ভিতরে রাস্তা কেটে ক্ষতস্থানে পৌঁছতে হয়। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক যেখানে হচ্ছে, তার আশপাশে তো নিরীহদের বসতি। ফলে মস্তিষ্কের ভাল অংশেরও ক্ষতি হত,’’ বললেন বাঙুরের নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বিমান রায়।
বিকল্প পদ্ধতি ‘এন্ডোভাস্কুলার কয়েলিং’। চিকিৎসকেরা জানান, এই পদ্ধতিতে ক্যাথিটারে কয়েল ভরে কুঁচকি দিয়ে সেটি ঢোকানো হয়। রক্তনালির গতিপথ ধরে তা পৌঁছয় হৃৎপিণ্ডে। তার পরে হৃৎপিণ্ডে থেকে মস্তিষ্কে যাওয়ার রাস্তা ধরে ক্যাথিটার হাজির হয় ঘটনাস্থলে। ক্যাথিটার থেকে কয়েল বেরিয়ে ক্ষত সারানোর কাজ শুরু করে। কাটাছেঁড়া ছাড়াই ক্ষতস্থানটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
এন্ডোভাস্কুলার কয়েলিংয়ের জন্য উন্নত মানের ডিএসএ ক্যাথল্যাব আছে এসএসকেএমে। কিন্তু নিউরো রেডিয়োলজি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত সেই পরিকাঠামো কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা অনেক। এসএসকেএমের খবর, অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে দক্ষতার অভাবে আশানুরূপ সাফল্য মিলছিল না। এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেন, লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক চাই। স্বাস্থ্য ভবনকে বিষয়টি জানানো হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব মেটাতে সহায় হয় রাজ্য সরকারের চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক নিয়োগ নীতি। ওই নীতি কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য ভবনের সহযোগিতায় চিকিৎসক দীপ দাসকে এ কাজে নিয়োগ করা হয়। সমন্বয়ের ঘাটতি মেটাতে নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বিমান রায়ের তত্ত্বাবধানে এই উদ্যোগে শামিল হন অ্যানাস্থেসিয়া, নিউরো সার্জারি এবং রেডিয়োলজির চিকিৎসকেরাও।
১৮ অক্টোবর এন্ডোভাস্কুলার কয়েলিং পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়েছে কানাইবাবুর। তিনি বললেন, ‘‘সরকারি হাসপাতাল ছাড়া আমার পক্ষে এই চিকিৎসা করানো সম্ভব ছিল না।’’ এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ জানান, ওই রোগীর আটটি কয়েল লেগেছে। শুধু কয়েলেরই দাম কয়েক লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে খরচের পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ। সেখানে পুরোপুরি বিনামূল্যে এই পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে।
নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বিমান রায় জানান, আগামী দিনে ব্রেন স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসায় এই যন্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। স্ট্রোকের রোগী ছ’ঘণ্টা পরে এলেও ওই যন্ত্রের ব্যবহারে চিকিৎসা সম্ভব। ‘‘সাব অ্যারাকনয়েড হেমারেজের অনেক ভাগ রয়েছে। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি হয় অ্যানিউরিজ়ম। বাঙুর ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যানিউরিজ়মের ক্লিপিং এবং অ্যাঞ্জিয়োগ্রাফি হত। কিন্তু কয়েলিংয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন না। বেসরকারি হাসপাতালের খরচ জোগাতে যাঁরা অক্ষম, তাঁদের কাছে খুবই ভাল খবর,’’ বললেন বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত নিউরোসার্জন আশিস ভট্টাচার্য।
এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সবাই মিলে সাধারণ মানুষকে উন্নত পরিষেবা দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।’’