দুর্গার মূর্তি। ফাইল চিত্র।
জনশ্রুতি, পাঁচ শতাব্দীর পুরনো এই পারিবারিক পুজো। কিন্তু মূল আকর্ষণ যেন নবমীতে। ওই দিন দেবী-আরাধনায় যোগ দেন, সৈয়দ হোসেন জামাল, আনারুল মিঞারা। সানন্দে তাঁদের বরণ করে নেন বাড়ির সদস্যেরাও। পুজো শেষে, সবাই এক বাক্যে বলেন, ‘‘এই সম্প্রীতির আবহই আমাদের শক্তি।’’ ঘটকবাড়ির দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এটাই এই অযোধ্যার গল্প। এক চিলতে এই গ্রামটির অবস্থান পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা ব্লকে।
ঘটকবাড়ির বর্তমান সদস্য হরিচরণ ঘটক জানান, পুজো শুরু করেছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ, সাধক অভয় ঘটক। পুজো শুরু হয় গ্রামের বাইরে, অজয় নদের পাড়ে, জঙ্গলের মধ্যে। পাষাণচণ্ডীতলা বাগান নামে ওই আরাধনা-ভূমির চার পাশে ঘন জঙ্গল থাকায় পরে, গ্রামের ভিতরে বাড়িতে পুজো শুরু করেন অভয়। এই পাষাণচণ্ডী দুর্গারই এক রূপ হিসেবে পূজিতা হন।
তবে নবমীর দিন সাবেক রীতি মেনে, এখনও ওই পাষাণচণ্ডীতলা বাগানেই চলে আরাধনা। ঘটকবাড়ির বর্তমান সদস্য তথা পুরোহিত বছর ৫৫-র হরিচরণ বলেন, “ছোট থেকেই দেখে আসছি, ওই দিন সকাল থেকে সাজো-সাজো রব পড়ে। অযোধ্যা তো বটেই, আসেন বনকাটি, সাতকাহনিয়ার বাসিন্দারাও। আসেন ভিন্-ধর্মের মানুষও। এটা একান্তই বিশ্বাস এবং সম্প্রীতির জোরের কারণেই ঘটে।”
এই তিনটি গ্রামে হাজার পঞ্চাশেক মানুষের বাস। তাঁদের মধ্যে হাজার দশেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। বেশির ভাগই কৃষিজীবী। কবে থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও এই পুজোয় যোগ দিচ্ছেন, সে বিষয়ে কোনও জনশ্রুতি নেই। তবে সাতকাহনিয়ার সৈয়দ হোসনে জামাল জানান, এই দিনটির জন্য তাঁরা বছরভর অপেক্ষা করেন। তিনি বলেন, “নবমীর সকালে আমার মতো অনেকেই, পুজোর জিনিস নিয়ে হাজির হই এখানে। পুরোহিতকে পুজোর জিনিস দিই। ভেদাভেদ দূর অস্ত্, এই পুজোর জন্য সকাল থেকে আমরা উপোসও করি।”
সাতকাহনিয়ারই সৈয়দ সালাম আজিম, আনারুল মিঞারা বলেন, “পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকি। প্রসাদ খেয়ে বাড়ি ফিরি। এ পুজো আমাদের নিজেদের।’’ এই ‘নিজের’ ভাবনা থেকেই সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে এলাকায় জল ঢোকার পরে, সবাই মিলে পাষাণচণ্ডীতলা বাগানে জমে থাকা বালি, কাদা সরিয়েছেন। পুজোর উঠোনে থাকেন, লাগোয়া এলাকার ইটাভাটার শ্রমিকেরাও।
পুজোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত স্থানীয় রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই পাষাণচণ্ডী দুর্গারই আর এক রূপ হিসাবে পূজিত হন। এই পুজোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, এ গ্রামের ঐতিহ্য।’’ কাঁকসার সিলামপুরের এক মসজিদের মৌলবি মতিউর রহমান খান বলেন, ‘‘সম্প্রীতির আদর্শই আমাদের দেশকে বেঁধে রেখেছে। অযোধ্যা গ্রামের এই দৃষ্টান্ত সে আদর্শেরই প্রতিফলন।’’