আলকাপের মহলায় বাঁশি বাজাচ্ছেন ‘ওস্তাদ’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।
আলকাপ, মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্টরূপ এবং অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ লোকনাট্য। গ্রামীণ নিরক্ষর ও অল্পশিক্ষিত কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষ ওই লোকনাট্যে অংশ নিতেন। ওই শ্রেণির মানুষের চিত্তবিনোদন, মনোরঞ্জনের জন্য এবং সর্বোপরি লোকশিক্ষার মাধ্যম রূপে আলকাপের উদ্ভব ঘটেছিল। আলকাপের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল অনুষ্ঠান পর্যায়, শিল্পীবৃন্দ। দর্শক-শ্রোতা সকলেই ছিলেন লোকায়ত। আলকাপ ছিল সম্প্রীতির একটা উল্লেখযোগ্য প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আলকাপের অনুষ্ঠানে হিন্দু দেবদেবীর জয়ধ্বনি, বন্দনাগান, পৌরাণিক ছড়া, ‘কাপ’ বা নাটক, ‘কবিয়ালি’ ইত্যাদি যেমন মুসলিম দর্শক-শ্রোতা সাগ্রহে শুনতেন, তেমনি আবার কখনও-সখনও স্থান বিশেষে হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে স্থানীয় পীরের জয়ধ্বনি ও বন্দনা গান কিংবা ইসলামি গান এবং মুসলিম আশয়-বিষয়কেন্দ্রীক ‘কবিয়ালি’ ইত্যাদিও হিন্দু দর্শক-শ্রোতা শুনতেন পরম উৎসুকে। হিন্দু-মুসলিমের ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক মিলন আলকাপের দ্বারা যতখানি সার্থক ভাবে ঘটেছিল, সমকালে ততখানি অন্য কিছুর দ্বারা সে ভাবে ঘটেনি বলে আমার বিশ্বাস।
আলকাপের সৃষ্টি ও উৎপত্তি প্রসঙ্গে বিভিন্ন অভিমত প্রচলিত রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি উত্তরবঙ্গে যে আলকাপের সৃষ্টি হয়েছিল তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। তবে গ্রাম-বাংলার বিবিধ পালা-পার্বণ, গাজন ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে গ্রামীণ সমাজে যে ‘কাপ’ বা ‘সঙ’ অভিনীত হয়ে থাকে, সম্ভবত তারই একটা উন্নত ও স্থায়ী রূপ—আলকাপ। শব্দগত উৎপত্তির দিক থেকে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, আলকাপ কথাটির মধ্যে ‘আল’ ও ‘কাপ’— এই দুটি সমার্থক বিষম মূল শব্দের দ্বিত্ব প্রয়োগ সংগঠিত হয়েছে। ‘আল’ ও ‘কাপ’—এই দুটি শব্দই ‘রঙ্গরস’-এর দ্যোতক।
এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক তথা এক সময়ের আলকাপের ‘ওস্তাদ’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন— ‘‘আলকাপ-এর আল্ শব্দটি আহ্লাদের অপভ্রংশ। আহ্লাদ>আল্লাদ>আল্। এটি পুরনো বাংলা শব্দ। অধুনা অসংখ্য বাংলা প্রাচীন শব্দ লুপ্ত। ‘আল’ শব্দ বেঁচে আছে ‘কাপ’ অর্থাৎ নাটিকার সঙ্গে জোড় বেঁধে। ‘আলকাপ’ কথাটির প্রকৃত অর্থ আমোদপ্রমোদমূলক নাটিকা। তবে কথাটির অর্থব্যঞ্জনা বিস্তারে এই অর্থও ব্যক্ত— ‘ব্যঙ্গ রসাত্মক নাটিকা’ বা ‘রঙ্গব্যঙ্গাত্মক নাটিকা।’’ প্রথম যুগের আলকাপের কোনও একটি দল সাধারণত কত জন শিল্পী সমন্বয়ে গঠিত ছিল, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে সময়ের অগ্রগতির ফলে আলকাপের আঙ্গিক ও প্রয়োগ-প্রকরণ রীতির যেমন উন্নতি ঘটেছিল, তেমনি শিল্পীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বিগত বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত আমি ব্যক্তিগত ভাবে ১৬ থেকে ১৮ জন শিল্পী সমন্বয়ে গঠিত আলকাপের দল দেখেছিলাম। ‘ওস্তাদ’, ‘কপে’, ‘ছোকরা’, ‘পার্শ্ব-কপে’, ‘পার্শ্ব-অভিনেতা’, ‘দোহার’ ছাড়াও ‘হারমোনিয়াম’, ‘তবলা’, ‘জুড়ি’ বা কত্তাল’ বাদ্যযন্ত্রের বাদক মিলিয়ে আলকাপের দল গঠন করা হত।
‘ওস্তাদ’: ওস্তাদ ছিলেন একাধারে দলের মাস্টার বা শিক্ষক, পরিচালক ও নির্দেশক এবং সর্বোপরি দলের প্রধান। দলের সমস্ত দায়-দায়িত্ব থাকত সেই দলের ওস্তাদের উপরে। তাঁর নামেই দলের পরিচিতি ঘটত। প্রখ্যাত ওস্তাদরা নাচ-গান, অভিনয়, ছড়া রচনা ও কবিয়ালিতেও দক্ষ হতেন।
‘কপে’: আলকাপের ‘কাপ’ বা নাটকে সাধারণত যিনি মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করতেন, তাঁকেই কপে বা কপ্যা বলা হত। কাপ অনেক সময়ে ‘সঙ’ হিসেবে গণ্য করা হত বলে কপেকে সঙ্দার বা সঙাল হিসেবে অভিহিত করা হত। ‘কাপ’-এ দর্শকদের হাসানোর একটা চেষ্টা থাকত। এই হাসানোর ভূমিকায় প্রধানত থাকতেন কপে। কিন্তু নিছক দৈহিক অঙ্গভঙ্গি দিয়েই নয়, রসাত্মক সংলাপ ও নিজস্ব ভঙ্গিতে, যাতে দর্শক-শ্রোতা না হেসে পারতেন না। অবশ্য আদর্শ কপে হতে হলে নিজস্ব রসবোধ, বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব মতো গুণাবলী একান্ত আবশ্যক ছিল। কপের সঙ্গে অনেক সময় কোনও কোনও দলে এক ‘পার্শ্ব কপে’ও থাকত। কপের সঙ্গে পার্শ্বকপেও তাঁর রসাত্মক সংলাপ দিয়েও দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতেন।
‘ছোকরা’: আলকাপে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ছোকরা। প্রথম দিকে সাধারণত ছোকরা’র সংখ্যা এক জনই ছিল। পরবর্তী সময়ে দু’জন। এমনকি তিন জন ছোকরা থাকত কোনও কোনও আলকাপ দলে। ছোকরা নাচ-সহযোগে গান করতেন। আবার কাপ অভিনয়ের সময়ে নারীর ভূমিকায় অংশ নিতেন ছোকরা। ছোকরাদের মাথায় মেয়েদের মত লম্বা চুল থাকত। আলকাপে অংশ নেওয়ার সময়ে মেয়েদের মত শাড়ি-ব্লাউজ, হাতে চুড়ি এবং কানে দুল পরতেন কোনও কোনও ছোকরা। আর মুখে সামান্য স্নো-পাউডার মাখতেন। নাচের সময়ে ছোকরা পায়ে ঘুঙুরও বাঁধতেন। অবশ্য ছোকরা ছিল এক জন স্বাভাবিক কিশোর। প্রকৃতপক্ষে নাচের উপযুক্ত দেহ-সৌষ্ঠব, সুশ্রী চেহারা ও গানের উপযুক্ত কন্ঠমাধুর্য এবং সাধারণত ১২-২০ বছর বয়সী ছেলেরা ছিল আদর্শ ছোকরা হওয়ার উপযুক্ত। ছোকরা’র নাচ-গান-অভিনয় ও নারীসুলভ ঠাট-ঠমক ইত্যাদির প্রশিক্ষণ হত ওস্তাদের কাছে। তবে অনেক সময়ে সিনিয়র ছোকরা’র কাছেও এক জন জুনিয়র ছোকরা প্রশিক্ষণ নিত, তাও নিতে হত ওস্তাদের নির্দেশে।
ওস্তাদ, কপে, ছোকরা— তিন জন আলকাপের অপরিহার্য ও প্রধান শিল্পী হলেও পার্শ্ব-অভিনেতা, দোহার এবং হারমোনিয়াম, তবলা ও জুড়ি, এই সব বাদ্যযন্ত্রের বাদকগণেরও গুরুত্ব আলকাপে কম ছিল না। পার্শ্ব-অভিনেতা কাপ বা নাটকের প্রয়োজনে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতেন। আর ছোকরা’র গানের, কপে ও ছোকরা’র দ্বৈত গানের এবং ওস্তাদের ছড়ার ও আশয়-বিষয়কেন্দ্রীক ‘কবিয়ালি’র ধুয়ো সমস্বরে দোহার’রা গাইতেন।
সাধারণ গ্রামীণ খেটে-খাওয়া মানুষরা আলকাপ দলে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন, ফলে সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে কিছুটা হলেও স্থূলতা ও আদিরসের প্রাধান্য দেখা যেত। সে কারণেই বিগত বিশ শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত গ্রাম থেকে দূরের খোলা মাঠে, কিংবা কোনও আমবাগানে অথবা কোনও পুকুর পাড়ে খোলা আকাশের নীচে মঞ্চস্থ হত আলকাপ। দর্শক-শ্রোতার মাথার উপরে কোনও রকম ছাউনি বা আচ্ছাদন থাকত না। তবে কোথাও কোথাও চট-তালাই টাঙিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আলকাপের অনুষ্ঠান চলত। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের দশকে জেলার প্রখ্যাত ওস্তাদ ঝাঁকসা ওরফে ধনঞ্জয় সরকার প্রমুখ আলকাপের অনুষ্ঠানকে কিছুটা শ্লীল ও রুচিসম্পন্ন করে তোলার জন্য বিশেষ ভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
এক সময়ে আলকাপ জগতে ওস্তাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। ভারতীয় গণনাট্যে সঙ্ঘের সঙ্গে থাকাকালীন জেলা গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বের পরামর্শে এবং নিজের দায়বদ্ধতা থেকে তিনি আলকাপের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি জেলা ও জেলার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে ‘ওস্তাদ সিরাজ’ এবং ‘সিরাজ মাস্টার’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।