পুলিশি হেফাজতে সগুণায় উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজ। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।
তল্লাশির ফলাফল দেখে সিআইডি তো থ! উদ্ধার হয়েছে গোটা একটা অস্ত্রাগার, সঙ্গে বোমা-বন্দুক তৈরির সরঞ্জামও।
শনিবার ভোরে কল্যাণীর সগুণা এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও একটি ক্লাবে হানা দিয়ে সিআইডি ৩৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, ১০০ রাউন্ডের বেশি কার্তুজ এবং ১০০টি তাজা বোমা উদ্ধার করেছে পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি গোয়েন্দারা অস্ত্র তৈরি ও বিক্রিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে আট জনকে গ্রেফতার করেছে। একটি অস্ত্র-কারখানারও হদিশ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সেখান থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছে অস্ত্র তৈরির যন্ত্রপাতি ও লেদ মেশিনও।
সিআইডি সূত্রের খবর, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ২৯টি ওয়ান-শটার বন্দুক, একটি দেশি ৯ এমএম পিস্তল, ৪টি একনলা ও দু’টি দোনলা বন্দুক। সিআইডি-র স্পেশাল সুপার চিরন্তন নাগ বলেন, ‘‘যারা ধরা পড়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দুষ্কর্মের পুরনো অভিযোগ রয়েছে। তবে অস্ত্রশস্ত্র কোথায় তারা বিক্রি করত, এখন সেটাই তদন্ত হচ্ছে।’’ সম্প্রতি নদিয়ায় আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় স্থানীয় কয়েক জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদের কয়েক জনের কাছ থেকেই বেআইনি অস্ত্র সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য মেলে। তার জেরেই শনিবারের অভিযান।
সিআইডি জানায়, প্রশান্ত বিশ্বাস, সুশান্ত বিশ্বাস, বিকাশ বিশ্বাস, প্রতীক বিশ্বাস, রাজীব মণ্ডল, নির্মল মণ্ডল, ভবরঞ্জন ব্যাপারি ওরফে ভোগি ও সাহেব সরকার ওরফে শাহেনশা— সকলেই সগুণার বাসিন্দা। সিআইডি-র দাবি, প্রশান্তই অস্ত্র কারবারের মূল পাণ্ডা। এর আগে একটি খুনের মামলায় ২০০৮-এ তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে সে শর্তাধীন জামিন পায়।
প্রশান্ত অপরাধ জগতের সঙ্গে আগাগোড়া যুক্ত বলে দাবি সিআইডি-র। সেই সুবাদে বেআইনি অস্ত্র তৈরি থেকে বিক্রি— সবই তার মদতে করা হতো। বিহারের মুঙ্গের থেকে কাঁচামাল এবং কারিগর এনে সগুণায় প্রশান্তর বাড়ির পাশে একটি গ্যারেজে ওই অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো।
সিআইডি-র বক্তব্য, স্থানীয় দুষ্কৃতী ছাড়া রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা অপরাধীদেরও অস্ত্র-বোমা সরবরাহ করত আদতে তোলাবাজ প্রশান্ত। টাকা নিয়ে সে খুনও করত। গোয়েন্দাদের দাবি, প্রাথমিক জেরায় প্রশান্ত জানিয়েছে, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে এলাকায় ফিরে আসে ও তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতার আশ্রয় পায়। তার পর সগুণা এলাকায় ঠিকাদারির পাশাপাশি সে তোলবাজি এবং বেআইনি অস্ত্রের কারবার শুরু করে। প্রশান্তর দাদা সুশান্তর ইমারতি ব্যবসা রয়েছে। তাকেও ধরা হয়েছে। গত পুর নির্বাচন ও লোকসভা উপ-নির্বাচনে প্রশান্ত ও তার দলবলকে কল্যাণী ও গয়েশপুরে তৃণমূলের হয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে বলে এলাকার অনেকেই পুলিশকে জানিয়েছেন। কল্যাণী শহর তৃণমূল সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অস্ত্র উদ্ধারের সঙ্গে দলের কারও যোগাযোগ নেই। প্রশান্ত দলের কোনও পদে নেই। কেউ দুষ্কর্মে যুক্ত থাকার প্রমাণ মিললে, প্রশাসন ব্যবস্থা নিক।’’
এ দিন ভোরে সিআইডি-র ১০ জনের একটি দল সগুণায় ঢোকে। প্রথমেই তল্লাশি শুরু হয় প্রশান্তর বাড়িতে। সেখানে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়। এর পরে প্রশান্তকে জেরা করে বাকি অস্ত্র মেলে। একটি গ্যারেজের ভিতর থেকে উদ্ধার হয় অস্ত্র তৈরির লেদ মেশিন। তবে, মুঙ্গেরের কোনও কারিগরকে এ দিন ধরা যায়নি। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, প্রশান্তর বাড়ির পিছনের খাল পাড়ের একটি ঘর থেকে ১০০টির বেশি বোমা এবং কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার হয়। ওই ঘরেই বোমা তৈরি করা হতো।
প্রশান্তর স্ত্রী পাপিয়া বিশ্বাস এ দিন অভিযোগ করেন, সিআইডি তল্লাশির নামে অত্যাচার করেছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা রাতে ঘুমোচ্ছিলাম। পুলিশ ডাকাতের মতো বাড়িতে হামলা করে। আমাকে বিছানায় ফেলে পেটানো হয়। আমার দশ মাসের মেয়েকে তুলে আছাড় মারার ভয় দেখানো হয়।’’ তবে, সিআইডি-র কর্তারা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এ দিন সগুণায় গিয়ে দেখা যায়, মোড়ে মোড়ে জটলা। এলাকার ছ’-ছ’টা বাড়ি থেকে এত অস্ত্র কী করে উদ্ধার হল, তা-ই এখন পাড়়ার লোকেদের জল্পনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা জানান, পাড়ায় প্রশান্ত কোনও গোলমাল করত না। তবে ও ঠিকাদারির সব কাজ পাচ্ছিল বলে ওর বিরুদ্ধে গোষ্ঠীর এক যুবকের সঙ্গে ওর সম্প্রতি গোলমাল হয়েছিল। ওই যুবককেও খুঁজছে পুলিশ।
এ দিকে, সিআইডি-র উদ্ধার করা ১০০টি বোমা নিয়ে আতঙ্কে ভুগছেন এলাকার মানুষ। গোয়েন্দারা বোমাগুলি উদ্ধার করে স্থানীয় লিচুতলার মাঠে একটি প্রাথমিক স্কুলের সামনে রেখে যায়। কিন্তু বোমাগুলি নিষ্ক্রিয় করা হয়নি। স্থানীয় থানা সূত্রে খবর, সিআইডি-র নিষ্ক্রিয় করার কথা বোমাগুলির। বোমাগুলি এ দিন রাত পর্যন্ত মাঠের মাঝখানে বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল। থানার দুই হোমগার্ড সেগুলি পাহারা দিচ্ছেন। বোমাগুলি ফেটে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকার মানুষ।