যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনকে মাওবাদী-মার্ক্সবাদীদের আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করে গোড়া থেকেই তৃণমূলের প্রচার চলছিল। সেখানে ‘মারাত্মক অস্ত্রধারী বহিরাগতদের’ সমাগমের তত্ত্ব দিয়েছেন খোদ পুলিশ কমিশনার। এ বার যাদবপুরের প্রতিবাদকে নেশাখোরদের আন্দোলনের তকমা দিলেন তৃণমূলের তরুণ সাংসদ তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যাকে আবার পরোক্ষে সমর্থন জোগালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। পুরো ঘটনা ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধতেও দেরি হয়নি।
রবিবার অভিষেকের ফেসবুক পোস্টে যাদবপুরের ছাত্র-আন্দোলন সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘মদ, গাঁজা, চরস বন্ধ। তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ?’ প্রসঙ্গত, আজ সোমবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর তরফে যাদবপুরের পাল্টা মিছিল হওয়ার কথা। অনেকের মত, সেই মিছিলেও অভিষেকের মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের চাপে পড়েই কি শাসকদল এ ভাবে প্রতিবাদের গায়ে কালি ছেটানোর কৌশল নিচ্ছে?
শিক্ষা, প্রশাসন ও রাজনৈতিক জগতের একাংশ ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তেমনই ইঙ্গিত পাচ্ছেন। ওই মহলের বক্তব্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের জেরে উপাচার্যকে মাঝরাত পর্যন্ত ঘেরাও করে রেখেছিলেন পড়ুয়ারা, পুলিশ যাঁদের বেধড়ক পিটিয়ে উপাচার্যকে ‘মুক্ত’ করে। এ হেন নজিরবিহীন দমননীতির প্রতিবাদে এবং উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে যাদবপুরের পড়ুয়ারা রাস্তায় নেমেছেন, তাঁদের আন্দোলনে এখন সামিল হয়ে গিয়েছেন বহু বিশিষ্ট মানুষও। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপাল ছাত্রদের ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেছেন। আন্দোলনের ঢেউ রাজ্যের সীমানা ডিঙিয়ে দিল্লি-বেঙ্গালুরুতে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নিছক ছাত্র আন্দোলনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের চেহারা নিচ্ছে বলে কারও কারও দাবি।
আর ঠিক এই পরিস্থিতিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর আত্মীয় তথা সাংসদের এ হেন ফেসবুক-লিখন স্বভাবতই নজর কেড়েছে। অনেকের মতে, অভিষেকের মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী। যাদবপুর-আন্দোলনে জড়িত অনেকের অভিযোগ, আন্দোলনের মূল বিষয় থেকে নজর ঘোরাতেই শাসকদলের সাংসদ এমন কথা বলেছেন। যার পিছনে ‘গভীর রাজনৈতিক কৌশলের’ ছায়াও দেখছেন কেউ কেউ।
বস্তুত মঙ্গলবার রাতে পুলিশ যাদবপুরের পড়ুয়াদের উপরে লাঠি চালানোর পরে মমতা-মন্ত্রিসভারই যে বর্ষীয়ান সদস্য ‘বেসুরে’ কথা বলেছিলেন, এককালের সেই দাপুটে ছাত্রনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় মন্তব্য এড়িয়ে যান। সে দিন পুলিশ দিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে সরব হলেও সুব্রতবাবু এ দিন অভিষেকের মন্তব্য তো দূর, ছাত্র আন্দোলন নিয়েও কথা বলতে চাননি। যা দেখে অনেকের ধারণা, সুব্রতবাবুর উপরে চাপ এসেছে। একই ভাবে প্রথমে মুখ খুলেও পরে চুপ করে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর এক মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
অন্য দিকে ‘যুবা নেতা’ অভিষেকের পথ ধরে তৃণমূলের অনেকে ফেসবুকে যাদবপুর-আন্দোলনকে নেশাখোরদের আন্দোলন বলে প্রচার করেছেন।
অভিষেক কেন এমন মন্তব্য করলেন?
অভিষেকের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন বা এসএমএসে ধরা যায়নি। তৃণমূলের ছাত্র নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাও কিছু বলতে চাননি। তবে মুখ খুলেছেন যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। সাংসদের মন্তব্যকেই সিলমোহর দিয়েছেন তিনি। “বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পড়ুয়া রোজ গাঁজা আর মদ খেতেই ক্যাম্পাসে আসে। সন্ধের পরে তাদের সঙ্গে বহিরাগতেরাও আসে। আমি এটা বন্ধ করার চেষ্টা করছি।” এ দিন রাতে বলেছেন অভিজিৎবাবু। শুনে প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের কী প্রতিক্রিয়া?
উপাচার্যের কথায় পড়ুয়ারা ক্ষুব্ধ হলেও বিশেষ বিস্মিত নন। আর্টস বিভাগের এক ছাত্রীর মন্তব্য, “উপাচার্য তো শাসকদলেরই লোক। তিনি এমপি’র গলায় গলা মেলাবেন, এ আর নতুন কথা কী!” ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘অভিষেক নিজে শিক্ষিত সাংসদ। তিনি এমন কথা বললেন কী ভাবে?”
শনিবারের মিছিলে বহু বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষ পা মিলিয়েছিলেন। অভিষেক কার্যত তাঁদেরও অসম্মান করেছেন বলে পড়ুয়াদের অভিযোগ। আন্দোলনকারী ছাত্র শৌভিক মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘অভিষেকবাবু এটাই বলতে চেয়েছেন যে, শনিবারের মিছিলে যাওয়া মানুষেরাও গাঁজা-মদের দাবিতে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন!” শনিবারের মিছিলে থাকা সাংস্কৃতিক জগতের লোকজনও অভিষেকের মন্তব্যকে কটাক্ষ করেছেন। নাট্যকর্মী সৌমিত্র বসুর যেমন প্রশ্ন, “উপাচার্য তো প্রকাশ্যে পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেননি! গাঁজা, মদ খাওয়ার কথা সাংসদ জানলেন কী করে?”
সাংসদের মন্তব্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তেই পাল্টা ঝড় উঠেছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটেও।