ছিবিতে অনুব্রত মন্ডল
স্ত্রী-র অসুস্থতা অথবা মায়ের মৃত্যু। ব্যক্তি জীবনে চরম সঙ্কটের মুহূর্তেও দলের কাজ থেকে বিরত থাকেননি তিনি। দলকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। করোনা আবহেও টানা বুথ ভিত্তিক কর্মী সম্মেলন করে চলেছেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত। পুজোর আগে এ দফায় তা শেষ হয়েছে শনিবার।
গত মাস দু’য়েক ধরে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা ধরে সভা করছেন অনুব্রত। প্রতিটি বুথের কর্মীদের কথা শুনছেন। এই ধকল নিতে যে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে আসছে শরীর মন, তা প্রকাশ পাচ্ছে দৃশ্যতই। প্রবীণ মন্ত্রীকে ‘অপদার্থ’ বলা থেকে, কর্মীকে বার করে দেওয়া— একাধিক সভায় নানা অভিযোগ উঠেছে। তবে তা সামলেও নিয়েছেন। বিধানসভা নির্বাচনের জন্য নিজের রুটিনই বদলে ফেলেছেন কর্মীদের প্রিয় ‘কেষ্টদা’। অনুব্রত বলছেন, ‘‘কষ্ট হয়। অস্বীকার করে লাভ নেই। দলটাকে ভালবাসি। দিদিকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ভালবাসি। তাই কষ্টটা কষ্ট বলে মনে করি না। তবে প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে। তা ছাড়া বয়সও বেড়েছে।’’
দলের কর্মীরা জানাচ্ছেন, সন্ধ্যা বেলায় ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিনের সভার প্রস্তুতি নেন তাঁদের কেষ্টদা। সে জন্য বেশ খানিকটা বদলে এসেছে দৈনন্দিন রুটিনে। অনুব্রতের কথায়, ‘‘আগে দেরিতে উঠতাম। এখন সকাল সাড়ে ৭টায় উঠে পড়ি। নিয়ম করে হাঁটি। তার পর চা খাই। এর পর ফিজিও থেরাপি করাই।’’
অনুব্রত জানান, সকালে পৌনে ১০টা নাগাদ স্নান সেরে পুজো করেন তিনি। তার পর দু’টি হাতে গড়া রুটি খান। সঙ্গে ছোলার ডাল, পেঁপে ভাজা। ইচ্ছে হলে একটা মাছ ভাজা। বেলা ১১টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন সভার উদ্দেশ্যে। বেরোনোর সময় শসা, পেয়ারা-র মত কিছু ফল এবং বাড়িতে বানানো চা সঙ্গে থাকে। সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি ফিরে স্নান। তারপর লাল চা, ইচ্ছে হলে মুড়ি আদা ভাজা। রাতে ফের দুটো হাতেগড়া রুটি এবং সব্জি। অনুব্রতের কথায়, ‘‘রাত সাড়ে ১০টার পরে শুতে চলে যাই। পরদিন উঠে ফের একই রুটিন।’’
তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩০২১টি বুথের প্রতিটিতে ৬০ জনের কমিটি করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক ভাবে তার মধ্যে ২০ জন মহিলা। সেই কর্মীদের উপরে এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলির সুবিধে-অসুবিধে, অভাব-অভিযোগ, দলের নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ থাকলে সেটা দেখতে বলা হয়েছে। যে দায়িত্ব কর্মীদের উপরে চাপানো হয়েছে সেটা জানতেই টানা বুথ ভিত্তিক সম্মেলন করছেন অনুব্রত। দিনে দুই থেকে তিন গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি বুথ ধরে আলোচনা চালাচ্ছেন। বীরভূম ও পূর্ব বর্ধমান মিলিয়ে মোট ২২৫টা মোট সভা করতে হবে। এমন উদ্যোগে খুশি দলের কর্মীরাও।
বিরোধীদের কটাক্ষ, এত দিন বিধানসভা বা ব্লক ভিত্তিক কর্মী সম্মেলন করতেন শাসক দলের জেলা সভাপতি। পায়ের তলা থেকে মাটি সরেছে বলেই বুথ ভিত্তিক কর্মী সম্মেলন ডেকে একটা মরিয়া চেষ্টা করছেন তিনি। তৃণমূল অবশ্য সেটা মানতে নারাজ। দলেরই নেতা কর্মীদের একাংশ মনে করাচ্ছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে পাঁচটি বিধানসভা এলাকায় বিজেপির তুলনায় পিছিয়ে থাকার কারণ যদি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জনসংযোগ দুর্বল হওয়া, মোদী হাওয়া, মেরুকরণ ইত্যাদি ফ্যাক্টর হয়ে থাকে, তাহলে আরও একটি বড় কারণ ছোট ছোট এলাকায় এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার বিরোধ। সেই ছোট ছোট খামতি মেটাতেই কেষ্টদা আসরে নেমেছেন বলে দাবি কর্মীদের। এতে তৃণমূল স্তরের কর্মীও একেবারে খোলাখুলি কেষ্টদার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। সমস্যার কথা তুলে ধরছেন।
অনুব্রত মণ্ডল বলছেন, ‘‘দলের ভিত্তি-ই হল বুথ ভিত্তিক সংগঠন মজবুত থাকা। কেন, কী সমস্যার জন্য একটি বুথে পিছিয়ে আছি জানার জন্যই তো সম্মেলন করছি। প্রতি বুথে ৬০ জন, তার মধ্যে ২০ জন মহিলা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহজ স্বাভাবিক ছবি উঠে আসছে।’’ কিন্তু তিনিই তো বলেছিলেন উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তা হলেও এত মানুষ তাঁদের নানা সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। শুনে খারাপ লাগে না? অনুব্রতের জবাব, ‘‘কথা শোনার জন্যই তো সভা। বিরক্ত হলে চলবে কী করে?’’
লক্ষ্মী পুজো মিটলে ফের ছুটবেন তিনি। বিধানসভা ভোট চলে এল যে! বহু নির্বাচনী যুদ্ধের সেনাপতি কেষ্টদা বিলক্ষণ জানেন, এখন ‘কষ্ট’ মানেই পরে ‘কেষ্ট’ মেলার আশা!