ষাটোর্ধ্ব মানুষটি এখন দিনভর কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন। তবে শরীর ও মনের এই অবস্থাতেও তিনি সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। বেশ করেছে। তাদের আদালতে তুলুক। বলা হচ্ছে, আমি নাকি তদন্তে সহযোগিতা করছি না!
বুধবার সকালে আনিস খানের মৃতদেহের ফের ময়না-তদন্তের জন্য তাঁর বাবাকে রাজি করাতে বাড়িতে আসেন আমতা-২-এর বিডিও মাসুদুর রহমান। ছবি: সুব্রত জানা।
পাঁচ দিন আগে বাড়ির ছোট ছেলে ‘খুন’ হয়েছেন। সেই শোক তো আছেই, তার পর থেকে ঘটনাক্রমে তাঁদের মানসিক চাপ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে বলে দাবি করলেন হাওড়ার আমতার ‘নিহত’ ছাত্রনেতা আনিস খানের পরিবারের লোকজন। আনিসের বৃদ্ধ বাবা সালেম খানের রক্তচাপও গত তিন দিনে বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি। ঘটছে ধৈর্যচ্যুতিও।
গত শুক্রবার গভীর রাতে আনিসের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে একাধিক বার পুলিশে ফোন করেছিলেন সালেম। পুলিশ আসে পরের দিন সকাল ৯টা নাগাদ। তার পর থেকে তদন্তের জন্য ঘন ঘন। অথচ, প্রথম থেকেই সালেম সিবিআই তদন্ত চাইছেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে বুধবার সালেম বলেন, ‘‘যখন পুলিশকে চাইলাম, এল না। এখন ঘন ঘন আসছে। নানা প্রশ্ন করছে। এত উৎপাত! বারবার বলছি পুলিশ নয়, সিবিআই চাই।’’
পরিবারের উদ্বেগ বাড়িয়েছে মঙ্গলবার গভীর রাতে সালেমের বড় ছেলে সাবিরের মোবাইলে আসা একটি হুমকি-ফোনও। তাতে বলা হয়, সিবিআই তদন্ত চাইলে তাঁদের প্রাণে মেরে দেওয়া হবে। এই ফোনের কথা পুলিশকে জানানো হয়েছে। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, ইন্টারনেট-কল করা হয়েছিল ভিআইওপি-র মাধ্যমে। কে বা কারা সেই ফোন করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সাবির বলেন, ‘‘আব্বার রক্তচাপ ছিল ১৪০/৮০। তিন দিনে বেড়ে হয়েছে ১৭০/১০০। চিকিৎসক এসে নিয়মিত পরীক্ষা করে যাচ্ছেন। যখন পুলিশের দরকার ছিল, তখন আব্বা তা পাননি। এখন যখন আমরা পুলিশ চাইছি না, তখন তাদের এসে অসুস্থ মানুষকে বিরক্ত করার কী দরকার, বুঝতে পারছি না। এ তো মানসিক অত্যাচার! আমরা নিতে পারছি না।’’
আনিসের দেহের ফের ময়না-তদন্তের প্রস্তাব এ দিনই তিন-তিন বার শুনতে হয়েছে সালেমকে। সকালে থানা থেকে এক আধিকারিক যান সালেমের অনুমতি নিতে। সালেম রাজি হননি। তার পরে একই আর্জি নিয়ে কিছু ক্ষণ পরে আসেন সিটের আধিকারিকেরা। এ বারেও সালেম পত্রপাঠ প্রস্তাব নাকচ করেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, আদালতের আদেশ বা সিবিআই ছাড়া তিনি আর কারও কথায় ময়না-তদন্ত করাতে দেবেন না।
সিটের আধিকারিক নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে ময়না-তদন্তের পক্ষে সওয়াল করলে সালেম প্রশ্ন তোলেন, “তা হলে কি প্রথম ময়না-তদন্ত ঠিক ছিল না? আপনারা নিজেদের করা ময়না-তদন্তকে যখন নিজেরাই বিশ্বাস করছেন না, তখন আমরা কী ভাবে বিশ্বাস করব যে এ বারেও সঠিক ময়না-তদন্ত হবে?”
বেলা ১২টা নাগাদ আমতা-২ ব্লকের বিডিও ব্লক মেডিক্যাল অফিসারকে নিয়ে হাজির হয়ে যান ময়না-তদন্ত করানোর প্রস্তাবে সালেমকে রাজি করানোর জন্য। এ বারেও সালেম আপত্তি জানান। ধৈর্য হারিয়ে সালেম বিডিওকে বলেন, ‘‘দেখুন ছেলের খুনের তদন্ত নিয়ে রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের কোনও কথা আমি শুনব না। ছেলের দেহের এক বার তো ময়না-তদন্ত হয়েছে। তার রিপোর্ট এবং ফরেন্সিক রিপোর্ট পরীক্ষা করিয়ে দেখব। যদি দেখি তাতে গরমিল আছে, তখন আদালতে আমি নিজে থেকে ছেলের দ্বিতীয়বার ময়না-তদন্ত করানোর জন্য আর্জি জানাব। সিবিআই চাইলেও ময়না-তদন্ত করাতে দেব। রাজ্য পুলিশের কথা শুনব না।’’ শেষে বিরক্তির সঙ্গে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘যদি দরকার হয় পুলিশ যে ভাবে আনিসকে খুন করেছে, আমাকেও খুন করুক। তখন আমার দেহের ময়না-তদন্ত করাবেন।’’ এই কথা শুনে বেরিয়ে যান বিডিও।
আনিসের পরিবার পুলিশের উপরে আস্থা রাখতে না-পারলেও সিট এ দিন আমতা থানার এক হোমগার্ড এবং সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছে সিট। তবু আশ্বস্ত হতে পারছেন না সালেম। ছবি দেখে তিনি ধৃতদের চিনতে পারেননি।
ওই পরিবারের লোকজন জানান, চোখের সামনে ছেলের খুন হয়ে যাওয়া, ময়না-তদন্ত নিয়ে বিস্তর টানাপড়েন, পুলিশের দেরিতে তৎপর হওয়া, তারপর ঘনঘন আনাগোনা, নবান্নের ডাক, সিট-এর জিজ্ঞাসাবাদ, আনিসের মোবাইল হেফাজতে নেওয়ার জন্য তাঁকে আইনি নোটিস ধরানোর চেষ্টা, হুমকি-ফোন এবং শেষে ফের ছেলের দেহের ময়না-তদন্তের প্রস্তাব— এ সবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন সালেম।
ষাটোর্ধ্ব মানুষটি এখন দিনভর কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন। তবে শরীর ও মনের এই অবস্থাতেও তিনি সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। বেশ করেছে। তাদের আদালতে তুলুক। বলা হচ্ছে, আমি নাকি তদন্তে সহযোগিতা করছি না! তা হলে পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করল কিসের ভিত্তিতে? আসলে সবই দিদির নাটক। সিবিআই তদন্তের দাবি যাতে না করি সেই চেষ্টা। পুলিশের তদন্তে আমাদের কোনও আস্থা নেই। সিবিআই তদন্ত চাই।’’