বুধবার এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা জানান, যে দু’জন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
আনিস-হত্যার ঘটনায় নিজে থেকে সিবিআই তদন্তের পথে হাঁটবে না রাজ্য সরকার। হাওড়ার ছাত্রনেতার মৃত্যুর তদন্তে সোমবার যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করা হয়েছে, তারাই যে ঘটনার তদন্ত করবে, বুধবার তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবার এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা জানান, যে দু’জন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই সঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘আমরা চাই নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। অভিযুক্ত পুলিশকর্মীরা যাতে তদন্তে প্রভাব খাটাতে না পারে, তার জন্যই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত নিরপেক্ষই হবে। আইন আইনের পথে চলবে। আমি তদন্তে কোনও হস্তক্ষেপ করতে চাই না।’’
কিন্তু পাশাপাশিই সিবিআই তদন্ত নিয়ে রাজ্যের অনীহার কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট যে, সিবিআই-কে তদন্তভার দিলেই তারা দোষীদের খুঁজে বার করতে পারবে, তেমন নয়। মমতার কথায়, ‘‘সিপিএম বা বিজেপি-র স্বার্থ দেখার জন্য আমি আসিনি। মানুষের স্বার্থ দেখতে এখানে আছি। আমাদের এতটা দুর্বল ভাববেন না। সিপিএম এত কথা বলছে, দেখাতে পারবে ওরা কখনও কাউকে গ্রেফতার করেছে কি না? সিবিআই-ই বা কী তদন্ত করেছে! সিঙ্গুরে তাপসী মালিকের হত্যার কী হল? সিবিআই তো তদন্তভার নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদকের প্রতিরূপ (রেপ্লিকা) পাওয়া গিয়েছে? সেখানেও তো সিবিআই তদন্ত করেছে! হাথরস আর উন্নাওতে তো সিবিআই তদন্ত করছে না? এ সব আমরা জানি।’’
প্রসঙ্গত, আনিস-কাণ্ডে বুধবার আমতা থানার হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা এবং সিভিক ভলান্টিয়ার প্রীতম ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুক্রবার মধ্যরাতে আমতায় আনিসকে ‘খুনের’ অভিযোগ ওঠার পর থেকেই ওই ছাত্রনেতার পরিবারের তরফে সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছে। আনিস-হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায়-নামা রাজনৈতিক দলগুলিও সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছে। আনিসের বাবা সালেম খান এবং দাদা সাবির খান একাধিক বার প্রকাশ্যে তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এর পরেই সোমবার সাংবাদিক বৈঠক করে আনিসের মৃত্যুর তদন্তে সিট গঠনের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশিই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আনিস আমার ফেভারিট ছেলে। গত বিধানসভা ভোটে আমাদের অনেক হেল্প করেছিল।’’ বুধবারেও মমতা আনিসের পরিবারকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্তই করবে। ঘটনাচক্রে, রাজ্য পুলিশের ডিজিপি মনোজ মালব্যও সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে সিট-এর সদস্যদের নাম কথা ঘোষণা করে আনিসের পরিবারকে নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিলেন।
সোমবার সিট গঠনের পর রাতেই আমতায় পৌঁছে যান সিটের সদস্য সিআইডি-র এডিজি জ্ঞানবন্ত সিংহ, সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) মিরাজ খালিদ এবং ব্যারাকপুর কমিশনারেটের যুগ্ম কমিশনার ধ্রুৱজ্যোতি দে ।
প্রথমে তাঁরা আমতা থানায় গিয়ে তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন। তার অব্যবহিত পরেই আমতা থানার দুই পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয় এবং এক জন হোমগার্ডকে ‘বসিয়ে’ দেওয়া হয় কর্তব্যে গাফিলতির কারণে।
এর পর মঙ্গলবার সকালে আনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন সিটের সদস্যেরা। কিন্তু আনিসের বাবা সালেম পরিষ্কার বলে দেন, ‘‘রাজ্য পুলিশের তদন্তে আমাদের আস্থা নেই। পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা সিবিআই তদন্ত চাই।’’যাকে সিটের তরফে ‘তদন্তে অসযওগিতা’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়। মঙ্গলবার রাতেও এক বার সালেম ও সাবিরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সিটের সদস্যেরা। অসমর্থিত সূত্রের খবর, তখন তাঁরা আনিসের ফোনটি চেয়েছিলেন। তাঁদের বলা হয়, আদালত বা সিবিআই না-চাইলে ফোন দেওয়া যাবে না। সেটিকেও ‘তদন্তে অসহযোগিতা’ বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
ওই দু’টি ঘটনার সূত্রে বুধবার রাজ্যপুলিশের ডিজি আনিসের পরিবারের কাছে তদন্তে সহযোগিতা করার আর্জি জানিয়েছেন। সোমবার সকালে ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার সুব্রত ভৌমিক গিয়েছিলেন আনিসের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। আনিসের বাবা সালেম ও দাদা সাবিরের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বয়ান রেকর্ড করেন তিনি। এর পর আনিসের বাড়িতে যান গিয়েছিলেন হাওড়া গ্রামীণের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইন্দ্রজিৎ সরকার। তাঁর সঙ্গে অবশ্য কথাই বলতে চাননি পরিবারের সদস্যেরা।
আনিসের মৃত্যুর পর থেকেই খোঁজ মিলেছে না আনিসের ফোনটির। পরিবারের সদস্যদের কাছে আরও একবার আনিসের ফোনের খোঁজ করেন ইন্দ্রজিৎ। আনিসের বাবা অবশ্য সাফ জানিয়ে দেন, ফোন তাঁদের কাছেই আছে। বাড়ির তিন তলা থেকেই তা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ওই ফোন তিনি পুলিশের হাতে দেবেন না। যদি আদালত বলে, তবেই ফোন দেবেন। নয়তো সিবিআই-কে দেবেন। সালেমের কথায়, ‘‘পুলিশ ছেলেকে মেরেছে! ওদের ফোন দেব না।’’
তদন্তে ‘স্বচ্ছতা’ বজায় রাখতেই আনিসের দেহের দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্ত করতে চেয়ে পরিবারের কাছে অনুমতি চেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সে অনুমতিও দেননি আনিসের বাবা। আগেই তিনি অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের অন্ধকারে রেখেই ছেলের দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তাঁর দাবি, যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যত বারই ময়নাতদন্ত করুক, কোনও লাভ নেই! যা নিয়ে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্তের জন্য গিয়েছিল পুলিশ। তা করতে দেওয়া হল না।’’
বার বার নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়ে মমতা জানান, ১৫ দিনের মধ্যেই সিট তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে বলে তিনি আশাবাদী। একই কথা বলেন ডিজিপি-ও। তিনি বলেন, ‘‘মৃতের পরিবার সুবিচার পাবে। যাঁরা আনিসের বাড়ি গিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের আশা, আগামী দু’তিনদিনের মধ্যে আমরা একটা পরিষ্কার ছবি পাব।’’
তবে আনিসের পরিবার যে সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড় থাকবে, তা স্পষ্ট। তারা মোবাইলে এমন একটি ভিডিয়োও দেখাচ্ছে, যেখানে রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবিতে আন্দোলনে নেমে তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা বলেছিলেন, ‘‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারাই তদন্ত করবে?’’ একই কথা এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে বলছে আনিসের পরিবার। ঘটনাচক্রে, রিজওয়ানুর-কাণ্ডে নাম জড়ানো আইপিএস অফিসার জ্ঞানবন্ত আনিস-কান্ডে গঠিত সিটের নেতৃত্বে থাকায় সিবিআই তদন্তের দাবি আরও জোরগলায় তুলছে আনিসের পরিবার।
অন্যদিকে, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরও বক্তব্য, ‘‘গোটা ঘটনার সঙ্গে রাজ্য পুলিশের নাম জড়িয়ে গিয়েছে। তাই এই ঘটনার তদন্ত পুলিশের করাই উচিত নয়।’’ বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের পরেও আনিসের বাবা বলেছেন, ‘‘অভিযুক্ত দুই পুলিশকর্মী গ্রেফতার হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু আমরা সিবিআই তদন্তই চাই।’’