—ফাইল চিত্র।
হাওড়ার আমতায় ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুরহস্য ভেদের জন্য রাজ্য সরকারের গড়া ‘সিট’ বা বিশেষ তদন্তকারী দলের উপরে প্রাথমিক ভাবে আস্থা রেখেছে কলকাতা হাই কোর্টও। কিন্তু পদে পদে প্রশ্নের মুখে পড়ছে সেই সিট। তদন্ত শুরু করার পরে প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গেলেও এখনও দু’জন অভিযুক্তের হদিস মিলল না কেন, সেই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। আনিসের শোকার্ত বাবা সালেম খান সিটের বিরুদ্ধে বার বার সরব হয়েছেন, অনড় আছেন সিবিআই তদন্তের দাবিতে। আমজনতা থেকে আইনজীবী, এমনকি পুলিশের একাংশেরও প্রশ্ন, সত্যিই কি নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করতে পারছে সিট? নাকি তারা সবই ধামাচাপা দিতে চাইছে? পুলিশের একটি অংশ মেনে নিচ্ছে, ওই ছাত্রনেতার অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত যে-গতিতে এবং যে-পদ্ধতিতে এগোচ্ছে, তাতে তদন্তকারীদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আনিস মামলার গোড়া থেকেই পুলিশের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমতা থানার কর্মীরা মাঝরাতে আনিসের বাড়িতে গিয়েছিলেন কেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এক জন হোমগার্ড এবং এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়া সে-রাতে থানাকর্মীদের দলে বাকি দু’জন কারা ছিলেন, সেই বিষয়েও সিটের মুখে কুলুপ। এই কারণেই সংশয়-সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী নীলাদ্রিশেখর ঘোষের বক্তব্য, পুলিশ তো বলতেই পারছে না, কেন ওই বাড়িতে গিয়েছিল। কোনও সমন ছাড়া পুলিশ তো কোনও নাগরিকের বাড়িতে হানা দিতে পারে না। বাড়িতে ঢুকে তাড়াও করতে পারে না। যদি পুলিশ এ ভাবে হানা দেয়, তা হলে ধরেই নিতে হবে যে, পুলিশের উদ্দেশ্য সৎ নয়।
সর্বস্তরে যে-সব প্রশ্ন জোরদার হয়েছে, সেগুলি হল: আনিস তো দাগি অপরাধী বা জঙ্গি ছিলেন না। তা হলে তাঁকে বেপরোয়া ভাবে তাড়া করা হল কেন? ভয়ের মুখে আনিস যাতে পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যান, সেই সম্ভাবনাটাকে বাস্তবে নিশ্চিত করে তোলার দুরভিসন্ধি থেকেই কি তাঁকে তাড়া করা হয়েছিল? সে-ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের ধারা প্রয়োগ করা না-হলেও আনিসের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষ ভাবে তাদের দায়ী করা যাবে কি না, সেটাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, সে-রাতে রক্তাক্ত আনিসকে ফেলে রেখে পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল কেন? কেনই বা থানায় ফোন করা সত্ত্বেও কোনও আরটি ভ্যান সে-রাতে ঘটনাস্থলে যায়নি? তা হলে কি ওখানে কী কী ঘটতে পারে, আগেভাগেই সেই সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল আমতা থানা?
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, এলাকায় আনিস যাতে গোলমাল সৃষ্টি না-করেন, সেই মুচলেকা আদায় করতে গিয়েছিলেন থানাকর্মীরা। কিন্তু মুচলেকা আদায়ের জন্য মাঝরাতে পুলিশি অভিযান চালানোর প্রয়োজন কী, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। আইনজীবী নীলাদ্রিশেখরবাবুর বক্তব্য, মুচলেকা আদায়ের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। থানা একটি সমন পাঠাবে এবং পূর্ব নির্দিষ্ট দিনে মহকুমা বিচারকের কাছে গিয়ে মুচলেকা দিতে হবে।
দু’জন অভিযুক্তের ব্যাপারে সিট যে-ভাবে মুখে কুলুপ এঁটেছে, তা নিয়েও কৌঁসুলি শিবির ও জনমানসে প্রশ্ন রয়েছে। নীলাদ্রিশেখরবাবুর মতো বহু আইনজীবী বলছেন, আমতা থানার সব কর্মীকে আনিসের বাবার সামনে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিলেই তো সে-রাতে কারা বাড়িতে গিয়েছিল, তাঁর পক্ষে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হত। পুলিশের একাংশ বলছেন, ওই এলাকায় সে-রাতে কোন আরটি ভ্যানের ডিউটি ছিল এবং সেই গাড়িতে কোন অফিসার ছিলেন, তাঁকে ধরে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করলেও রহস্যের সমাধান হয়ে যেতে পারত। তা না-হওয়ায় সিট আদতে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চাইছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে জোরালো ভাবে।
আনিসের দাদা সাবিরকে ফোনে হুমকি দেওয়ার বিষয়টিও এর মধ্যে সামনে এসেছে। ওই হুমকি-ফোনের ঘটনায় অভিযুক্ত সারওয়ার হোসেনকে কলকাতার বেনিয়াপুকুর থেকে গ্রেফতার করা হলেও হুমকি দেওয়ার কারণ এখনও জানতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশি সূত্রের খবর, সারওয়ার নানা ধরনের সাইবার অপরাধে যুক্ত। কলকাতা পুলিশও তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। সারওয়ার তপসিয়ার বাসিন্দা। বেনিয়াপুকুরে ঘর ভাড়া নিয়ে অপকর্ম করে বেড়াত সে। তার কাছে বেনামি সিমকার্ড মিলেছে।