বোলপুরে সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহ। সঙ্গে কৈলাস বিজয়বর্গীয় ও দিলীপ ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র
দু’দিনের রাজ্য সফর শেষে একাধিক ইস্যুতে রাজ্য সরকার ও শাসকদলকে তীব্র আক্রমণ করলেন অমিত শাহ। রবিবার বোলপুরে রোড শো-এর শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাথাপিছু আয়— সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলার তীব্র নিন্দা করে রাজ্যের শাসকদলকে নিশানা করে অমিতের তোপ, ক্ষমতার দম্ভেই এমন আক্রমণ। তৃণমূলকে তোলাবাজ, পরিবারবাদী, দুর্নীতির সরকার আখ্যা দিয়ে বিজেপি প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতির দাবি, রাজ্যের মানুষই তৃণমূল সরকারকে সরিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাবে। তৃণমূলের প্রায় সব আক্রমণের জবাবও দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
রবিবার বোলপুরে রোড শো শেষে সাংবাদিক বৈঠকের গোড়ার দিকেই পশ্চিমবঙ্গ কত পিছিয়ে, তার পরিসংখ্যান দেন অমিত। ১৯৬০ সালের সঙ্গে শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয়ের তুলনা টেনে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ৬ দশকে রাজ্য কী ভাবে পিছিয়ে পড়েছে। এই সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে অমিতের তোপ, ‘‘এ রাজ্যে প্রথম শুধু তোলাবাজিতে, পরিবারতন্ত্রে, দুর্নীতিতে।’’ এই সূত্রেই আমপানের কেন্দ্রীয় অনুদান, করোনার সময় কেন্দ্রের পাঠানো খাদ্যশস্য-সহ একাধিক বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
জে পি নড্ডা, কৈলাস বিজয়বর্গীয় থেকে শুরু করে অমিত শাহকে বহিরাগত বলে বিজেপি নেতাদের লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে তৃণমূল। সাংবাদিক বৈঠকে সেই প্রসঙ্গও ওঠে। তাতে অমিত কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর ‘মাথাখারাপ’ হয়ে গিয়েছে বলে কটাক্ষ করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মমতা দিদি যখন কংগ্রেসে ছিলেন, তখন ইন্দিরা গাঁধী বা নরসিংহ রাও এ রাজ্যে আসতেন। তখন কী বলতেন? আপনি কি এমন রাজ্য চান, অন্য রাজ্য থেকে কেউ এ রাজ্যে আসবে না? বাংলার মানুষ উদার, খোলা মনের, এই সব প্রচারে তাঁরা কান দেবেন না। আমার মনে হয় ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। জাতীয় দলের সংজ্ঞাটাই ভুলে গিয়েছেন। উনিও একটা জাতীয় দলের প্রধান। তার পরেও এই প্রশ্ন তোলেন কী করে?’’ সৌগত রায় পাল্টা বলেন, ‘‘ও সব পুরনো কথা বলে লাভ কী? আমরাও একটা সর্বভারতীয় দল। কিন্তু আমরা বাইরের কাউকে এনে প্রচার করি না। ওঁরা করেন। তাই বহিরাগত বলা হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: ‘সহানুভূতি কাড়ার চেষ্টা করছে তৃণমূল’ ৩৫৬ নিয়ে বললেন অমিত ।। ওঁরাই তো বলছেন: সৌগত
মমতাকে নিশানা করে অমিতের কটাক্ষ, ‘‘দিদি, আপনি চিন্তা করবেন না। এ রাজ্যের মানুষই আপনার সরকারকে ত্যাগ করবে। আপনার সরকার আর থাকবে না। স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘‘বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবেন বাংলার ভূমিপুত্রই।’’
গত ১০ ডিসেম্বর রাজ্য় সফরে এসে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার পথে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির কনভয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। রবিবার সাংবাদিক বৈঠকের প্রথমেই সেই ঘটনার নিন্দা করে অমিত বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, এই ঘটনা শুধু নড্ডাজির কনভয়ে হামলা নয়,সেটা গণতন্ত্রের উপর হামলা। গণতান্ত্রিক পথে মানুষই এর জবাব দেবে।’’
আরও পড়ুন: ‘ফ্যাক্ট চেক’ প্রকাশ করে টুইটারে অমিত শাহকে বিঁধলেন ডেরেক
এই হামলার ঘটনাকে ঘিরে কেন্দ্র রাজ্য সঙ্ঘাত চরমে উঠেছিল। দায়িত্বে থাকা তিন আইপিএস অফিসারকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে চেয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কিন্তু রাজ্য তাতে রাজি না হয়নি। শেষে তিন জনকে বদলি করে দিয়েছে কেন্দ্র। রবিবারের সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে, এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত কিনা। জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত হয়, এমন কোনও কাজ আমরা করিনি। কেউ অভিযোগ তুললে প্রমাণ দিন।’’ যদিও তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘আইপিএস-দের বদলি নিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের ভূমিকা সঠিক। কেন্দ্রের ভূমিকা ভুল। আমরা এটা নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ব।’’
এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের বিষয়টি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি হয়তো সমবেদনা কুড়ানোর জন্য় বলছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসনের মতো বিষয় এই রকম সাংবাদিক সম্মেলনে হয় না।’’ যদিও সৌগত রায় পাল্টা বলেন, ‘‘আমরা তো ৩৫৬ ধারার কথা বলিনি, অমিত শাহের দলের কৈলাস বিজয়বর্গীয় আর মুকুল রায় বলছেন। আমরা বলেছি, ৩৫৬ ধারা হলে আমরা তার প্রতিবাদ করব।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সব সভাতেই দাবি করেন, এনআরসি করতে দেবেন না। নয়া নাগরিকত্ব আইন তৈরি হয়েছে। তার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ হয়েছে। দিল্লিতে জাতি-হিংসায় প্রাণ গিয়েছে বহু মানুষের। তার পরে অবশ্য করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ায় সেই সিএএ, এনপিআর, এনআরসি ইস্যু অনেকটাই পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। রবিবার সাংবাদিক বৈঠকেও সেই প্রসঙ্গ ওঠে। জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘করোনার জন্য পুরো প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। করোনার টিকা শুরু হলে তার পর সেই সব প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে।’’
শনিবার মেদিনীপুরের সভায় শুভেন্দু অধিকারী-সহ এক ঝাঁক তৃণমূল বিধায়ক-সাংসদ, প্রাক্তন সাংসদ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ২ বাম এবং এক কংগ্রেস বিধায়কও মেদিনীপুরের মঞ্চ থেকেই ধরেছেন গেরুয়া পতাকা। কিন্তু সবার নজর ছিল শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগদানের উপর। রবিবার অবশ্য বোলপুরের কোনও কর্মসূচিতেই শুভেন্দু ছিলেন না। সাংবাদিক বৈঠকে অবশ্য অমিত বলেছেন, ‘‘শুভেন্দু-সহ যে সব নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের স্বাগত জানাই।’’