দুই ছবি। শনিবার যাদবপুর কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল বৃষ্টিভেজা রাজপথে (বাঁ দিকে)। সোমবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পাল্টা মিছিল। ছবি: রণজিৎ নন্দী ও বিশ্বনাথ বণিক
বর্ষণেও গর্জে উঠেছিল ‘কলরব’। সোমবার দুপুরে তেমন বর্ষণ না থাকলেও ‘গর্জন’ তত গর্জাল না।
শনিবারের ছাত্র মিছিলের পাল্টা সমারোহ অনেকটা নিষ্প্রভ রয়ে গেল।
যাদবপুরের ছাত্রীনিগ্রহ এবং ছাত্র আন্দোলনের উপরে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শনিবার স্বতঃস্ফূর্ত জনজোয়ার দেখেছিল শহর। মিছিলে দাবি ছিল, উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। নিগ্রহের তদন্ত নিরপেক্ষ হতে হবে।
এ দিনের মিছিলের মূল স্লোগান কী? যাদবপুরের পড়ুয়ারা নেশাখোর। প্রতিবাদীরা সবাই ‘মাওবাদী-মার্কসবাদী’।
সুরটা অবশ্য রবিবারই বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে পুলিশ কমিশনার তাঁর রিপোর্টে মাওবাদীদের কথা বলেছিলেন। আর রবিবারই ফেসবুকে শাসক দলের ‘যুবা’ নেতা লিখেছিলেন, ‘মদ, গাঁজা বন্ধ! তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ?’ সোমবারের মিছিলে তিনি নিজে অবশ্য সশরীরে থাকেননি। কিন্তু তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা, ছাত্রনেতা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, মেয়র পারিষদ সুশান্ত ঘোষ বা মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কলেজপড়ুয়া-স্কুলপড়ুয়া-শিক্ষক থেকে শুরু করে একশো দিনের কাজের শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, ব্যবসায়ীরাও। তাঁদেরই গলায় সমবেত ভাবে এ দিন উঠে এসেছে অভিষেকের দেওয়া ‘মদ-গাঁজার’ তত্ত্ব। স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘মদ গাঁজা বন্ধ, যাদবপুরে গন্ধ’। কখনও বা ‘কোলে শুয়ে নেশায় চুর, দেখিয়ে দিল যাদবপুর’। মিছিলে আসা বেহালার বাসিন্দা, বিবেকানন্দ কলেজের কর্মী কিশোর মাইতি যেমন বললেন, “যাদবপুরে গাঁজা-মদের ঠেক ছিল। সেটা ভাঙা নিয়েই তো যত গণ্ডগোল, চেঁচামেচি। তার প্রতিবাদ করতেই এসেছি।”
শঙ্কুদেব এ দিন ঘোষণা করেছিলেন, ছাত্রীরা প্রথমে মিছিলে হাঁটবে। তার পরে ছাত্ররা। কিন্তু ভারে বা ধারে এ দিনের মিছিল যে শনিবারের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি, সেটা সাদা চোখেই ধরা পড়েছে। অথচ লোক টানতে কসুর করা হয়নি। তৃণমূলী শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা মিছিলে আসার ফতোয়া জারি করেছিল। বেশ কিছু স্কুল-কলেজ থেকে হাফছুটি দিয়ে এ দিন শিক্ষক-পড়ুয়াদের তুলেও আনা হয়েছিল। এই রকমই কয়েক জন দাঁড়িয়ে ছিল লাইন দিয়ে, বিড়লা তারামণ্ডলের পাশে। খাকি প্যান্ট-সাদা জামা আর তাদের আগে লাল পাড়-সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা। কথা বলে জানা গেল, ভাঙড়ের বোলেরহাট হাইস্কুলের অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী তারা। মিছিল উপলক্ষে প্রধানশিক্ষক আব্দুল্লাহ ইসলাম এ দিন স্কুলে হাফছুটি ঘোষণা করেছেন। তার পর শিক্ষকদের সঙ্গেই ছাত্রছাত্রীরা চলে এসেছে কলকাতায়।
কিন্তু আসল ফাঁকটা থেকে গিয়েছিল যে জায়গায়, তার নাম স্বতঃস্ফূর্ততা।
হুগলি থেকে আসা, পেশায় গাড়ির খালাসি সাগর চক্রবর্তী কিংবা হাওড়ার ষাটোর্ধ্ব মায়া সামন্ত যেমন স্বীকারই করলেন, “গ্রাম থেকে নেতারা বললেন, দলের মিছিলে যেতে। চলে এলাম।” আবার মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করা রাজবতী ধানুকের দাবি, “আমাদের বলা হয়েছে, মিছিলে না-গেলে আর এলাকায় কাজ পাব না। বাধ্য হয়ে আসতে হল।” সুতরাং শনিবারের মিছিলে হাততালি দিয়ে গান, স্বচ্ছন্দ শৃঙ্খলা কিংবা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের যে প্রাণবন্ত উপস্থিতি, তার কাছে গো-হারান হেরে যায় এ দিনের তৃণমূলী আয়োজন।
মিছিলের তাল ঠিক রাখতে তাই লাগাতার ঠেকনা দিতে হয়েছে ‘শঙ্কুস্যার’-এর ঘনিষ্ঠ মহলকে। স্লোগানের জোর কমে এলেই কিংবা ‘হোক গর্জন’-এর সঙ্গে আকাশে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়তে ভুল হয়ে গেলেই পাশ থেকে ধমক এসেছে, “হচ্ছেটা কী! গলাটা একটু চড়া, হাত ছুড়ে স্লোগান দে। দাদা (শঙ্কু) কিন্তু খুব রাগ করছে।” মিছিল চলতে-চলতেই মাঝখানে বহু জায়গায় পাতলা হয়েছে ভিড়। যা চোখে পড়েছে শঙ্কুবাবুরও। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি আগেভাগেই বলে রাখেন, “এত ভাল মিছিল হল। তা-ও কাল কিছু সংবাদপত্র ঠিক লিখবে, মিছিল ব্যর্থ আর মিছিলের জায়গায় জায়গায় অনেক ফাঁক ছিল।”
দুপুর দেড়টা নাগাদ মিছিলের শুরুতেই বিশৃঙ্খলা। মিছিল যাবে অকাদেমির দিক থেকে পার্কস্ট্রিটের দিকে। সেই মতো প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ। এ দিকে হুড়হুড় করে উল্টো দিক থেকে একের পর এক ছোট মিছিল মূল মিছিল ভেঙে ঢুকে পড়ছে। পরিস্থিতি সামলাতে ঘাম জবজবে চুড়িদার পাজামায় ছুটে বেড়াচ্ছেন শঙ্কুদেব। কিন্তু তিনি যে মাইকে ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দেবেন, সেই মাইক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
শনিবার বৃষ্টিভেজা শহরে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন সুমন মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, ঋ বা শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট জনেরা। ভারসাম্য রাখতে এ দিনের মিছিলে টলিউড তারকাদের পাশাপাশি সঙ্গীত ও নাট্য জগতের অনেক রথী-মহারথীকে দেখা যাবে বলে ভেবেছিলেন কর্মীরা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কেউই আসেননি। ইদানীং তৃণমূলের যে কোনও অনুষ্ঠানেই টিভি-সিনেমার কিছু মুখের উপস্থিতি প্রায় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কবি-শিল্পীর আসাও প্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিন কিন্তু তাঁদেরও দেখা মেলেনি। শুধু চোখে পড়েছে ব্যানার, ‘সুমন-স্বস্তিকা দিচ্ছে ডাক, ছাত্র গুন্ডামি স্বীকৃতি পাক’।
শনিবারের মতোই পুলিশ এ দিনও মিছিল আটকে দেয় মেয়ো রোডে। মিছিল থেকে কয়েক জন গেলেন রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে। সে দিনের মতোই ঘোষণা করা হল, রাজ্যপাল দাবি না-মানলে এখানেই বসে থাকা হবে। দিন-রাত। কিন্তু নেতৃত্ব বেরিয়ে যেতেই ভিড়ও ফাঁকা হতে শুরু করল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নেতৃত্ব যখন ফিরলেন, তখন ময়দান প্রায় ফাঁকা। বেশির ভাগই পা বাড়িয়েছেন বাড়ির দিকে।