সময়সাপেক্ষ বাড়িতে বসে করোনা পরীক্ষা। নিজস্ব চিত্র
করোনা চিকিৎসায় বাড়িতে থেকেও ভোগান্তি! করোনায় মৃদু উপসর্গ দেখা দিলে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে। টেলি মেডিসিন হেল্প-লাইনে পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এমন অভিযোগ উঠল যে, করোনা হয়েছে কিনা, বাড়িতে বসে টেস্ট করে জানতে গেলেই চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগী এবং তাঁর পরিবারকে।
সরকারি হাসপাতালগুলির তরফে বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় না। করোনা উপসর্গ নিয়ে গেলে, তবেই সেখানে চিকিৎসা হয়ে থাকে। বেসরকারি ল্যাবরেটরি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য বাড়ি থেকে রোগীর লালরসের নমুনা সংগ্রহ করছে। কিন্তু ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা পরিষেবা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরীক্ষার জন্য ‘ডেট’ পেতেই ৪ থেকে ৫ দিন হয়ে যাচ্ছে। রোগী করোনা আক্রান্ত কি না, সেই রিপোর্ট হাতে পেতে আরও দু’দিন। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারি অথবা বেসরকারি হাসপাতালেই ছুটতে হচ্ছে রোগীকে।
চিকিৎসক মহলের একাংশ মনে করছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা না করে সরকারের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ভ্যান-এর মাধ্যমে লালারসের নমুনা সংগ্রহ করার উপরে আরও জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে কন্টেনমেন্ট জোনগুলিতে। তা-হলে এত হয়রানি হবে না। প্রতিটি ওয়ার্ডে মোবাইল ভ্যান থাকলে, যাঁর মনে হবে লালারসের নমুনা দিয়ে আসতে পারবেন।
আরও পড়ুন: আচমকাই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ভেঙে পড়ল সেতু, বিচ্ছিন্ন ডুয়ার্স
আইসিএমআর অনুমোদিত শহরের নামী কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ল্যাবরেটরি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। আগে টেস্টের জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হলেও, এখন দাম বেঁধে দিয়েছে রাজ্য সরকার। অভিযোগ, বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে পিপিই কিট এবং আনুসাঙ্গিক খরচ দেখিয়ে এখনও বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। কমবেশি করোনা টেস্টের খরচ পড়ছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আগে থেকে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে বুক করতে হবে। কবে নমুনা সংগ্রহ করা হবে, তা ফোন করে জানানো হবে। এই প্রক্রিয়া অনেকটাই সময় সাপেক্ষ বলে মনে করছেন অনেকে। রিপোর্ট পেতে আরও ৭২ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে।
লালারসের নমুনা সংগ্রহের জন্য মোবাইল ভ্যান। নিজস্ব চিত্র
বাড়িতে বসে করোনা টেস্ট করা যায়-- সেই ধারণাও আবার অনেকেরই নেই, মানছেন চিকিৎসক সংগঠনগুলিও। তাঁদের বক্তব্য, এ বিষয়গুলি আরও প্রচারে আনতে হবে। সমস্ত ল্যাবরেটরি বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলিকে নজরদারির আওতায়ও আনা দরকার। গরিব বা বড়লোক দেখে করোনা হয় না। যত বেশি টেস্ট হবে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও আরও বাড়বে। গরিব মানুষের উপর যদি এত টাকার বোঝা চাপানো হয়, ওঁরা টেস্ট করাবেন কী করে? সরকার মোবাইল ভ্যানে নমুনা সংগ্রহে আরও উদ্যোগী হলে টাকাও লাগবে না।
কেন ভোগান্তি?
সরশুনার চ্যাটার্জি পাড়া এলাকায় বাসিন্দা এক ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার পর পরিবারের বাকিদের মৃদু উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তাঁরা ফোন করেছিলেন থানা, প্রশাসনিক অধিকারিক, সরকারি হেল্প লাইনে। তাঁদের বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পর তাঁরা বাড়ি থেকেই করোনা টেস্ট করাতে উদ্যোগী হন। একাধিক ডায়গনস্টিক সেন্টার, ল্যাবরেটরিতে ফোন করেন। সেখান থেকে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, দেরি হবে। অনেক বুকিং আছে।
এমনই অভিযোগ উঠেছে আরও অনেক জায়গায়। উত্তর কলকাতার হেদুয়াতেও একটি পরিবার টেস্ট করাতে চেয়ে খোঁজ করেন বিভিন্ন জায়গায়। তাঁদেরও অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বাড়াবাড়ি হলে তবেই সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স এসে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার আগে পরিষেবা তেমন মিলছে না।
আরও পড়ুন: প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে গেল সেতু, দেখুন ভিডিয়ো
বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে কোথায় সমস্যা, তা জানতে ফোন করা হয়েছিল কয়েকটি ডায়গনস্টিক সেন্টারে। বাড়ি থেকে নমু্না সংগ্রহের বিষয়ে নামী একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে, তাঁরা জানাতে চান, রোগীর কোনও লক্ষণ আছে কি না। সে বিষয়ে তথ্য জানার পর ফোন নম্বর নিয়ে নেন তাঁরা। তার পর বলা হয়, এ বিষয়ে আপনার দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে নেওয়া হবে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পরেও ওই ডায়গনস্টিক সেন্টারের তরফে আর যোগাযোগ করা হয়নি।
ঠিক একই ভাবে শহরের আরও নামী একটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে বলা হয়, ডাক্তারেরা লিখে দিয়েছেন তো কোভিড টেস্ট করতে হবে? তিনি আরও একটি নম্বর দিয়ে বললেন, আপনাকে ওই নম্বরে ফোন করতে হবে। টেকনিক্যাল ইস্যু হয়েছে। তবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত বুকিং আছে। তার পর হবে।
একই ভাবে বেহালার একটি নামী প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে ফোন করা হয় করোনা টেস্টের জন্য। তাঁরাও কয়েকদিন দেরি হবে বলে জানান। সেই সঙ্গে হাজার-বারোশো আরও অতিরিক্ত লাগবে বলেও জানিয়ে দেন। করোনা টেস্টের জন্য ২২৫০টাকা। শহরের আরও একটি প্রথম সারির ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে একই ভাবে টেস্টের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। কোথায় থাকেন, জানতে চান টেলি-অপারেটার। তিনি জানিয়ে দেন, কলকাতায় টেস্ট এখন হবে না। কেন হবে না? বলেন, এ বিষয়ে তথ্য দিতে পারছেন না। অন্য কোনও আইসিএমআর অনুমদিত প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে নিতে বলেন। তবে তিনি এ-ও জানিয়ে দেন, বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য পিপিই কিটের জন্য হাজার টাকা বেশি লাগবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক করোনাযোদ্ধা (যিনি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন) বললেন, “বহু মানুষ বাড়িতে বসে জেনে নিতে চাইছেন, তিনি করোনায় আক্রান্ত কিনা, কিন্তু যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করবেন, তেমন অভিজ্ঞ লোকের অভাব রয়েছে। একজন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে নমুনা সংগ্রহ করছেন। ফলে পরিষেবা দিতেও দেরি হচ্ছে। এই ঝামেলা এড়াতে অনেক ল্যাবই আবার নতুন করে বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।”
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক কৌশিক চাকী জানালেন, “হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাড়ি থেকে লালারসের নমুনা সংগ্রহ করছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আমাদের দাবি ছিল, বিশেষ করে কন্টেনমেন্ট জোনে মোবাইল ভ্যান করে এলাকা ভিত্তিক নমুনা সংগ্রহ করা হোক। যাঁর মনে হবে, সেখানে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসবে। কয়েকটি জায়গায় হচ্ছে। তবে অত্যন্ত কম। এই উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে। তা হলে এই সমস্যা আর থাকবে না।”
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)