স্মৃতির অ্যালবামে: মা দেবদত্তার কোলে ছোট্ট ঋতম।
কৃষুউউউ...।
ডাকটা কত দিন শোনেনি ঋতম। মা ডাকত আদর করে। পুজোয় নতুন জামা পরতে হবে। মা ডাকত, ‘কৃষু এ দিকে এসো’। দমদম পার্কের ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে। মা ডাকত, ‘কৃষু চলো। আমরা ঠাকুর দেখতে যাব’।
মা আর ডাকে না। আদরও করে না। পাঁচ বছরের ছেলেটা জানে না, মা আর ডাকবেও না কোনও দিন। দমদমের পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে সে রং-পেন্সিলের হিজিবিজি আঁকে। মা এসে দেখবে। মা আর কোনও দিন আসবে না, জানে না ছেলে। জানানোও হয়নি এখনও। সে শুধু জানে, ‘মা অফিস গিয়েছে।’
১৫ মাস হতে চলল কোভিড কেড়ে নিয়েছে ঋতমের মা দেবদত্তা রায়কে। বাংলা হারিয়েছে বছর আটত্রিশের এক নাছোড় করোনা যোদ্ধাকে। যিনি হুগলির চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে পরিবারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। গত বছর লকডাউনে যখন শ’য়ে শ’য়ে পরিযায়ী শ্রমিক ট্রেনে করে ডানকুনি স্টেশনে এসে নামছেন, দেবদত্তাই তাঁদের ‘ত্রাতা’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের পরীক্ষা করানো, হাসপাতালে বা সেফ হোমে পাঠানো— কোনও কাজেই ফাঁক রাখেননি।
পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরেছেন। দেবদত্তাও ফিরেছিলেন। গত বছর জুলাইয়ের শুরুতে ছেলেকে ‘জড়িয়ে-মড়িয়ে’ থাকবেন বলে ১০ দিন ছুটি নিয়েছিলেন। করোনার ছোবলে কয়েক দিনেই চিরছুটিতে চলে যান তিনি। স্ত্রীয়ের শেষ দিন অফিস যাওয়ার কথা মনে পড়ে স্বামী পবিত্রর, ‘‘সে দিন ও অফিস গিয়েছিল গণ-পরিবহণে। ফিরেছিল একই ভাবে। তুমুল বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে। তখন থেকেই একটু একটু করে শরীর খারাপ হতে শুরু করে। ভেবেছিলাম, বৃষ্টিতে ভেজার ফল। নিজের মতো করে ওষুধ খেয়েও না সারায় ডাক্তারের কাছে যায়।’’ পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়ে। শেষে হাসপাতাল। আর যুঝে উঠতে পারেননি।
স্ত্রীকে ‘দেব’ বলে ডাকতেন পবিত্র। দেব ছিল তাঁর বন্ধু, সহপাঠীও। পবিত্র মাসদুয়েকের বড়। ক্লাস ইলেভেনে একই স্যরের কাছে কেমিস্ট্রি পড়তে গিয়ে দু’জনের আলাপ। সেই আলাপই বদলে যায় জীবনের রসায়নে। ২০০৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক্সে এমএসসি পাশ করলেন দেবদত্তা। দু’বছর পরে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের চাকরি। তবে, একরোখা দেবদত্তা চেয়েছিলেন, প্রশাসনিক অফিসার হতে। ২০১০-এ ডব্লিউবিসিএস অফিসার হলেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশাসনিক চাকরি শুরু কৃষ্ণনগরে। তার পরে পুরুলিয়ায় বিডিও হিসেবে পোস্টিং।
সেখান থেকে বছর খানেক নবান্নে কাটিয়ে চন্দননগরে।
তারপর কাজ আর কাজ। ঊর্ধ্বতন অফিসাররা কিছু বললে শিরোধার্য। এমনও হয়েছে, ছেলের মাথা ফেটেছে, তাতেও কাজ শেষ না করে ফেরেননি দেবদত্তা। এক রাশ স্মৃতিতে ডুবে থাকেন পবিত্র, ‘‘এক-এক সময় বলতাম, এত কাজ করে মেডেল পাবি? পরে বুঝলাম, কাজটাই ওর প্যাশন।’’
দুর্গাপুজোয় দু’দিন ছুটি মিলত দেবদত্তার। স্বামী আর ছেলের সঙ্গে দমদম ঘুরে বেড়াতেন। এ প্যান্ডেল থেকে সে প্যান্ডেল। খাবারের দোকান, পার্ক, হুটোপুটি। মাঠের ধার, পুকুরের পাশ দিয়ে দস্যিপনা করে ঘরে ফিরত ঋতম। আবার কাজে ফিরতেন দেবদত্তা। সকালে মা বেরোনোর সময় কান্নাকাটি করত ঋতম। তাকে ভোলানোর জন্য পোশাকের উপরে হাউসকোট চাপিয়ে নিতেন দেবদত্তা। ছেলের কান্না থামলে বেরিয়ে পড়তেন।
মাকে কাছে না-পেয়ে প্রথম প্রথম কেঁদে ভাসত ছেলে। এখন কাঁদে না। বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে ঠাম্মার কাছে আর পিসির বাড়িতে দিন কাটে তার। মায়ের কথা মনে পড়লে পাছে ছেলে অস্থির হয়, দেওয়াল থেকে দেবদত্তার সব ছবি সরিয়ে রেখেছেন পবিত্র। দেবদত্তার জন্যই এখনও ছেলেকে কোনও বড় স্কুলে দেননি।
‘‘সব কিছু ঠিক থাকলে এ বছর দেবের বদলির কথা ছিল। ভেবেছিলাম, যেখানে বদলি হবে, ছেলেকে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করাব। তা আর হল কই!’’—আনমনা পবিত্র।
শরতের আকাশ তখন ঝকঝকে।
কাশ দুলছে।
মা আসছেন।
তৈরি কৃষুও। পুজোয় নতুন জামা হয়েছে। গত বছর ঠাকুর দেখা হয়নি। এ বার নিশ্চয় হবে।
ও জানে, মা আসবে।