মূল পদ্মা দূরেই, পদ্মার শাখায় ডিঙি ভাসিয়ে চলছে মাছের খোঁজ। নিজস্ব চিত্র
এক দিকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত। অন্য দিকে দু’মুঠো ভাত। সীমান্তে প্রতিনিয়ত চলা এই যুদ্ধে বার বারই জিতে যায় সীমান্তের রাঙাচোখ।
মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গিয়েছে পদ্মা। পদ্মাপাড়ের চাষি ও মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, সীমান্তে কোনও কিছু হলেই সবার আগে কোপ পড়ে তাঁদের উপরেই। এমনকি বাংলাদেশে কিছু হলেও নিষেধাজ্ঞা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের সামনে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে জলঙ্গির শিরচর এলাকা থেকে তিন জন মৎস্যজীবী মাছ ধরতে নেমেছিলেন পদ্মায়। অভিযোগ, তাঁরা বাংলাদেশের রাজশাহির চারঘাট উপজেলা সদরের বালুঘাট ঢুকে পড়েন। সেখানে তাঁদের আটক করে বিজিবি। পরে দু’জন ধীবরকে ছেড়ে দিলেও আটকে রাখা হয় প্রণব মণ্ডল নামে এক ধীবরকে।
অভিযোগ, পরে ওই ধীবরকে ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের মাধ্যমে ছাড়াতে গিয়ে বিজিবির গুলিতে নিহত হন এক বিএসএফ জওয়ান। গুরুতর জখম হন আরও এক জন। এ দিকে, আটক প্রণব মণ্ডলকে বিজিবি পরে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ওই ঘটনার পর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়েই মূল পদ্মায় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিএসএফ। স্থানীয় ধীবরেরা বিএসএফ ক্যাম্পে কারণ জানতে চাইলে শুনতে হচ্ছে, ‘উপরওয়ালা কা অর্ডার হ্যায়।’ ফের কবে থেকে মাছ ধরা যাবে বা আদৌ যাবে কি না সে ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট জবাব মেলেনি বিএসএফের কাছে।
ফলে শুধু জলঙ্গি এলাকার মৎস্যজীবী নন, জেলার বিভিন্ন এলাকায় পদ্মায় মাছ ধরে যাঁদের দিন চলে সেই মৎস্যজীবীদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। মৎস্যজীবীদের দাবি, এখন ইলিশের ভরা মরসুম চলছে। তাঁরা সকলেই কমবেশি ধার-দেনা করে জাল ও নৌকার বন্দোবস্ত করেছেন। অবস্থা এমন চলতে থাকলে তাঁরা না খেয়ে মরবেন।
দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের মুর্শিদাবাদের জেলা সম্পাদক বিদ্বানকুমার দাস বলছেন, ‘‘রবিবার থেকেই মৎস্যজীবীদের ফোন পাচ্ছি। গোটা জেলার পদ্মাপাড়ের মৎস্যজীবীরা এই ঘটনায় হতাশ। ইলিশের ভরা মরসুমে তাঁরা পদ্মায় নামতে পারছেন না। আমরা গোটা বিষয়টি লিখিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী ও মৎস্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’’
বিদ্বানবাবুর সংযোজন, ‘‘বছরের এই সময়টাই মৎস্যজীবীদের জন্য আদর্শ সময়। এই সময়ে পদ্মায় ইলিশ ছাড়াও অন্য মাছও মেলে। ফলে এই সময় এমন নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মৎস্যজীবীরা।’’
জলঙ্গির শিরচরের মৎস্যজীবী গোপাল মণ্ডল এ দিনও বাড়ির দাওয়ায় হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসেছিলেন। উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাছ ধরার জাল। তাঁর কথায়, ‘‘এ ভাবে আর কত দিন চলবে বুঝতে পারছি না। এমন চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।’’ ভগবানগোলা ২ ব্লকের চর লবণগোলার মৎস্যজীবী গোলাম রাব্বানি বলছেন, ‘‘সারা বছর মাছ ধরে সংসার চলে। আর এই সময়ে ইলিশ ছাড়াও বাড়তি যে মাছটা পাই তাতেই মহাজনের দেনা শোধ হয়। কিন্তু রবিবার থেকে পদ্মায় নামতে পারছি না। সব দিক থেকে বার বার আমাদেরই কেন বিপদে পড়তে হয়?’’
ভগবানগোলার মাঝের চরের প্রতাপ মণ্ডল বলছেন, ‘‘জলঙ্গির ঘটনায় যে আমাদের এলাকাতেও প্রভাব পড়বে তা ভাবতেই পারিনি। রবিবার খবরটা শোনার পর থেকেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’’
জলঙ্গির চাষি মিরচাঁদ মণ্ডল, আমিনুল মণ্ডলেরা বলছেন, ‘‘শুধু মৎস্যজীবীরাই নন, ওই ঘটনার পর থেকে আমরাও বিপদে পড়েছি। তবে এ বারই প্রথম নয়। যখনই সীমান্তে কিছু একটা ঘটে তখনই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে হয় আমাদের। সীমান্তের নিরাপত্তার কারণে ইতিমধ্যে পাটচাষ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আরও কী কী বন্ধ করতে হবে জানি না। বাবুরা তো ফরমান জারি করেই খালাস। আমাদের হাত মুখে কী করে উঠবে সে ব্যাপারে কারও ভাবনা নেই।’’
মুর্শিদাবাদ জেলায় মাছের সবচেয়ে বেশি জোগান দেয় এই পদ্মা। এখনও ইলিশের যা দেখা মেলে তা এই পদ্মায়। অনেকে নিরুপায় হয়ে মূল পদ্মা ছেড়ে শাখা পদ্মায় মাছের খোঁজ করছেন। কিন্তু সেখানে ইলিশ তো দূরের কথা, অন্য মাছও তেমন মিলছে না বলেই দাবি মৎস্যজীবীদের।
গোটা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের মোশারফ হোসেন। তাঁর কথায়, ‘‘জেলার হাজারও মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন জড়িয়ে আছে পদ্মার সঙ্গে। খুব দ্রুত গোটা বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান সূত্র খুঁজব আমরা।’’ কিন্তু মৎস্যজীবীদের প্রশ্ন, পদ্মায় তত দিন ইলিশ থাকবে তো?