নৈঃশব্দ্য বুঝিয়ে দেয়, সময় বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে জীবনের পর্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নৈঃশব্দ্য কি কখনও কখনও বেশি উচ্চকিত?
তাঁর কি তেমন মনে হয়? মনে হচ্ছে? তিনি জবাব দেন, “আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি। কোনও একটা নির্দিষ্ট ঘটনার পর তুমি একই রকম থেকে যেতে পারো না। তোমার একটা অংশও হারিয়ে যায় তার সঙ্গে। বাকি অংশটুকুতে হয়ত প্রলেপ পড়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যে অংশটা হারিয়ে যায়, সেটা ফিরে পাওয়া খুব কঠিন।”
তিনি কি নিজের একাংশ হারিয়ে ফেলেছেন? কথোপকথনের মধ্যে নৈঃশব্দ্য ঝুলতে থাকে। যে নৈঃশব্দ্য কখনও কখনও শব্দের চেয়েও উচ্চকিত। সেই নৈঃশব্দ্য বুঝিয়ে দেয়, সময় বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে জীবনের পর্যায়। একটা মন পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে থাকতে চায়। অন্য মন বলে— যে যায় সে চলে যাক।
সব্যসাচী চৌধুরী এমনিতেই অন্তর্মুখী। অপ্রগলভ। কিন্তু গত প্রায় একটা বছর তিনি প্রায় লোকচক্ষুরও অন্তরালে। লেখাপড়া করেছেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। কিন্তু অভিনয় তাঁর ভালবাসা। লেখালিখিরও শখ আছে। তার পাঠকও নেহাত কম ছিলেন না। কিন্তু এখন তাঁর কলম চলে না। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের দুনিয়া থেকে।
তবে টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় তাঁর যাতায়াত আছে। কাজের কারণে। যে স্টুডিয়োপাড়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঐন্দ্রিলার। ঐন্দ্রিলা শর্মা।
গত বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ছিল দুর্গাপুজো। তার অনেক আগে থেকেই সব্যসাচী তাঁর বন্ধু সৌরভ দাসেরা মিলে একটা ক্যাফে শুরু করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই ক্যাফে তৈরি হয়েছিল সল্টলেকে। গত বছর পুজোয় পুরো সময়টাই সেই ক্যাফেতে কাটিয়েছিলেন সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলা। সঙ্গে অন্য বন্ধুরা। পরিজনেরা। কালীপুজো, ভাইফোঁটা পর্যন্ত নির্বিঘ্ন ছিল সবকিছু। তখনও ঠিক ছিল, একটি ওয়েব সিরিজ়ের শুটিংয়ে গোয়ায় যাবেন ঐন্দ্রিলা। ভাইফোঁটার কয়েক দিন পর আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ১ নভেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দীর্ঘ যুদ্ধ, কঠিন লড়াই শেষে গত বছরের ২০ নভেম্বর চিরঘুমে চলে যান ঐন্দ্রিলা।
২০১৫ সালে ঐন্দ্রিলা জানতে পেরেছিলেন, তিনি মারণরোগে আক্রান্ত। তখন তিনি একাদশ শ্রেণি মাত্র। অস্থিমজ্জায় ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য দিল্লির এমসে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। টানা দেড় বছর চিকিৎসা চলে। পর পর কেমোথেরাপি। সঙ্গে বিবিধ ওষুধ। সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ঐন্দ্রিলা। ২০১৭ সালে ‘ঝুমুর’ সিরিয়াল দিয়ে অভিনয় জগতে আগমন তাঁর। ২০২১ সাল পর্যন্ত সুস্থ ভাবে কাজ করেছেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আচমকা ছন্দপতন। ডান কাঁধে আচমকা যন্ত্রণা শুরু হয় তাঁর। হাসপাতালে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, ঐন্দ্রিলার ডান ফুসফুসে একটি ১৯ সেন্টিমিটারের টিউমার আছে। আবার শুরু হয় কেমোথেরাপি। শেষে অস্ত্রোপচার করানোর সিদ্ধান্ত নেন ঐন্দ্রিলা। জটিল অস্ত্রোপচার সফল হয়। অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০২২ সালের মাঝামাঝি অভিনয়ে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করেন। সুস্থ হয়ে অগস্টে একটি সিরিজ়ের শুটিংও করেন। অগস্টের শেষদিনে মুক্তি পায় সিরিজ়টি।
তাঁর অসুস্থতাজনিত লড়াইয়ে আগাগোড়া ঐন্দ্রিলার হাতটি ধরে ছিলেন সব্যসাচী। দ্বিতীয় বার সুস্থ হওয়ার পর ঐন্দ্রিলার অভিনীত সিরিজ়ে সব্যসাচীর সঙ্গে তাঁকে দেখেছিলেন দর্শক। আরও একটি সিরিজ়ে অভিনয় করার কথা ছিল তাঁর। হয়নি। পুজোর পর আচম্বিতে অসুস্থতা। অতঃপর সব শেষ।
ঐন্দ্রিলার শেষযাত্রায় শেষ বার জনসমক্ষে সব্যসাচীকে দেখেছিল এই শহর। তার পরেই নৈঃশব্দ্যের বৃত্তে ঢুকে পড়েন তিনি। যে নিস্তব্ধতার আওয়াজ শব্দের চেয়েও বেশি। তাঁর হোয়াট্সঅ্যাপ স্টেটাসে লেখা তিনটি শব্দ— প্র্যাকটিস, পেশেন্স, পারসিভিয়ারেন্স। অনুশীলন, ধৈর্য, অধ্যবসায়। তিনি কি অধ্যবসায় নিয়ে ধৈর্যের অনুশীলন করেন অহরহ?
গত বছরের পুজোয় এমনই সাজগোজ করেছিল কলকাতা। এমনই ছিল আলোর রোশনাই। তফাত— গত পুজোয় সব্যসাচীর সঙ্গে ছিলেন হাত ধরার, যৌথ লড়াই, যৌথ যাপনের সঙ্গী। এই পুজোয় সেই পুজোর দিকে পিছু ফিরে তাকান সব্যসাচী। বলেন, “পুজোর সময় রাস্তায় এত হোর্ডিং দেখে মনে হয়, এটা যেন শুধু ব্যবসা হয়ে গিয়েছে! তাই বরাবর আমি এই সময়টায় বাইরে চলে যেতে চাইতাম। ‘সোলো ট্রিপ’-এ বেরিয়ে পড়তাম। বাইক নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এ বছর পুজোটা একই। কিন্তু আবার হয়তো একটু আলাদাও। অন্যান্য বার যেমন পুজোর সময় আমার মনে হত, বাঁধাধরা জীবন থেকে বেরিয়ে অন্য কিছু করি। সেটা এ বার নেই। ইচ্ছে করছে না। জানি না কেন।”
হয়তো জানেন না। হয়তো জানেন। হয়তো জানেন, এই পুজোয় ভারী একলা তিনি। স্মৃতি আঁকড়ে পুজোকে ফিকে হতে দিতে চান না। তবু এই পুজোর শহর তাঁকে মনে করায় অতীত-পুজোর কথা। গত পুজোর সময় সল্টলেকের ক্যাফেতে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত এখনও স্মৃতিতে ফ্রেমবন্দি তাঁর। প্রায় ১২টা মাস কেটে গিয়েছে। জীবন বদলে গিয়েছে সব্যসাচীর। “পুজো একই থাকে। কিছু কিছু জিনিস পাল্টে যায়। সে সব মানিয়ে নিয়েই পুজো চলবে। বাবার কাছে তাঁর ছোটবেলার পুজোর গল্প শুনি। বাবাও তো স্মৃতিরোমন্থন করেন। দাদুর সঙ্গে কী কী করতেন, কোথায় কোথায় যেতেন— এই সবকিছু। সেই দিনগুলোও তো ছিল। এখন আর নেই। কিন্তু পুজো পুজোর মতো হয়ে চলেছে।”
গত বছর পুজোর পরে নভেম্বর থেকেই একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন সব্যসাচী। তাঁকে প্রশ্ন করতে অনেকে ইতস্তত বোধ করেন। তিনি নিজেও নিজস্ব নৈঃশব্দ্যের বলয়ে থাকতেই পছন্দ করেন। তবু একের পর এক প্রশ্ন শুনতে শুনতে তিনি এক নিঃশ্বাসে বলেন, “আমি বরাবরই অন্তর্মুখী। বেশি কথা বলি না। কিন্তু এটা ভাবতে শুরু করলে তো কিছুই করা যাবে না! মূলত যেটা হয়, বেশ কিছু কাটানো সময়, বেশ কিছু জায়গা স্মৃতিকে আরও উস্কে দেয়। আবেগপ্রবণ করে দেয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে তো সব সময় সেটা হয় না। এখনও তো স্টুডিয়োয় কাজ করতে আসি। এই স্টুডিয়োপাড়াতেই ওর সঙ্গে আমার দেখা। তা বলে কি আমি কখনও স্টুডিয়োপাড়াতে আসব না? কখনও কাজ করব না? সেটা তো আমি করছি।’’
একটু বিরতি নিয়ে, ‘‘যদি বলি স্টুডিয়োয় আসতে আমার সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু সল্টলেকের ক্যাফেতে গেলে সমস্যা হচ্ছে, তা হলে তো সেটা ভণ্ডামি হয়ে যায়! এ রকম হয় না কখনও। একটা মানুষ চলে গেলেও সেই মানুষটা কোনও কোনও অংশে রয়ে যায়। এই বিষয়টা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজেদের মতো করে শোক কাটিয়ে ওঠেন। আমিও আমার মতো করে পরিস্থিতি সামলাচ্ছি। আমি একই আছি। এ বছর যে খুব বেশি ফারাক হয়েছে তা নয়।”
ঠিকই। হয়তো ফারাক হয়নি। হয় না। সকলেই নিজেদের মতো করে মানিয়ে নেন। তবু একটা মানুষ চলে গিয়েও জীবনের অনুষঙ্গে রয়ে যান। কিছু কিছু আবহে রয়ে যান। গত বছরের পুজোতেও এমনই সাজগোজ করেছিল কলকাতা। এমনই ছিল আলোর রোশনাই। এমনই ছিল পুজোর তুঙ্গ যাপন। সশব্দ উদ্যাপন। এ বছরের পুজোয় সুসজ্জিত শহর আছে। আলোর ঝলমলানি আছে। তার সঙ্গে অপার নৈঃশব্দ্য আছে।
নৈঃশব্দ্য কখনও কখনও শব্দের চেয়েও বেশি উচ্চকিত! তার সঙ্গে বসবাস করতে গেলে অধ্যবসায় নিয়ে ধৈর্যের অনুশীলন করতে হয়। প্র্যাকটিস। পেশেন্স। পারসিভিয়ারেন্স।