Kaushik Sen

‘নারদ কেলেঙ্কারির পরেও রুদ্রনীলের মনে হয়নি, মোহভঙ্গ হওয়া উচিত?’

দেশের ৪৯ জন বিদ্বজ্জন চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। বুধবারের সেই পত্রাঘাতে তাঁর সইও রয়েছে। আনন্দবাজারের সঙ্গে সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর বয়ানে উঠে এল রাজ্য রাজনীতি-টালিগ়ঞ্জ-রুদ্রনীল ঘোষও। মুখোমুখি কৌশিক সেন।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৯ ২০:০০
Share:

কৌশিক সেন। —নিজস্ব চিত্র।

দেশের ৪৯ জন বিদ্বজ্জন চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। বুধবারের সেই পত্রাঘাতে তাঁর সইও রয়েছে। আনন্দবাজারের সঙ্গে সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর বয়ানে উঠে এল রাজ্য রাজনীতি-টালিগঞ্জ-রুদ্রনীল ঘোষও। মুখোমুখি কৌশিক সেন।

Advertisement

প্রশ্ন: টালিগঞ্জের শিল্পীদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন মানুষজন। অনেকেই তো আয়ারাম-গয়ারাম। পরশু বামপন্থী তো কাল তৃণমূল, আজ বিজেপি!
কৌশিক: প্রথমেই বলে রাখি, একটা সময়ে আমি কিন্তু খুবই সিপিএম, একেবারে কর্মী ছিলাম। একটা বামপন্থী পরিবারে জন্মেছি। সত্যি কথাটা হচ্ছে, সিপিএম কিন্তু টালিগঞ্জে খুব বেশি নাক গলায়নি। শিল্পীদের বিষয়ে তো নয়ই। এই বাড়াবাড়িটা কিন্তু তৃণমূল আমলে শুরু হয়েছে।

প্রশ্ন: এর কারণটা কী?
কৌশিক: বাম আমলে ক’জন শিল্পীকে রাজনৈতিক প্রার্থী হিসাবে দেখা গিয়েছে? হাতে গোনা দু’এক জন। কিন্তু এই যে দলে দলে গ্ল্যামার জগতের লোকজন প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন, যে কোনও মিটিং-মিছিলে চলে যাচ্ছেন, এটা তৃণমূলের দান। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় আমরা অর্থাৎ থিয়েটার-সাহিত্য-সঙ্গীত জগতের লোকেরা রাস্তায় নেমে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিবাদ করেছিলাম। তাতে মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন। তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন, থিয়েটার, সাহিত্য বা বিদ্বজ্জনেরা নয়, যাঁরা আরও বেশি জনপ্রিয়— সেই টেলিভিশন-সিনেমা শিল্পীদের দলে আনলে লাভ হবে। তাতে সাময়িক ভাবে কাজ হয়েছিল। কারণ, তখন দলে দলে সকলে তৃণমূল হয়ে গেলেন। যাঁরা সিপিএম আমলে যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাও। ভণ্ডামিটা তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার নতুন ট্রেন্ড। যে মুহূর্তে দেখা গেল তৃণমূলের জাহাজটা ডুবন্ত, বিজেপির ক্ষমতায় আসার লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠছে, ফলে আর একটা পাল্টা প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

Advertisement

প্রশ্ন: শিল্পীদের সঙ্কটটা ঠিক কোথায়?
কৌশিক: সঙ্কটটা ঠিক কী, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না বোধহয়। এই সঙ্কট কবে থেকে তৈরি হল, তা-ও জানা নেই। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নাটকের আসামান্য প্রতিভাবান মানুষ হয়েও কোন সঙ্কটের জায়গা থেকে ভোটে দাঁড়ান এবং তৃণমূলের অংশ হয়ে ওঠেন তা আমি এখনও বুঝিনি।আমরা একটা নিরপেক্ষ মঞ্চ তৈরি করলাম। আমরা সিপিএমের বিরুদ্ধে বলছিলাম। সিপিএম ক্ষমতা থেকে চলে যাক, সেটা চাইছিলাম। কিন্তু প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, তৃণমূল ক্ষমতায় আসুক কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু আমরা যেন তৃণমূল না হয়ে যাই। আমরা যেন আমাদের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ধরে রাখতে পারি। আমাদেরই কয়েক জন সেই সময় বললেন, আমরা কাপুরুষ। বলা হল, নিরপেক্ষ থাকাটা অপরাধ। আর সেই মমতা ক্ষমতায় এসে মনে করলেন, আমার সব চাই। পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা থেকে টালিগঞ্জ, কোথাও কোনও বিরোধী থাকবে না। আজ সেই উল্টো খেলাটা খেলছে বিজেপি। আজ বোঝা যাচ্ছে, কেন আমরা সে দিন একটা তৃতীয় স্বরের কথা বলেছিলাম।

‘‘শিল্পীদের সঙ্কটটা ঠিক কী, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না বোধহয়।’’

প্রশ্ন: শিল্পীদের কি তা হলে কোনও রাজনৈতিক মূল্যবোধ নেই?
কৌশিক: মূল্যবোধটা বেশি আছে সেটাই কি বলা উচিত নয়? এক জন শিল্পীর বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হওয়া উচিত। এক জন শিল্পী কোনও রাজনৈতিক দলের হতে পারেন না। তাঁর মধ্যে টানাপড়েন থাকবে। এক জন রাজনৈতিক কর্মী যে ভাবে তাঁর দলের নির্দেশ মুখ বুজে পালন করেন, এক জন শিল্পীর তো সেটা করা সম্ভব নয়। উচিতও নয়।

প্রশ্ন: তা হলে রুদ্রনীলকে সমর্থন করছেন?
কৌশিক: না করছি না। রুদ্রনীলের হয়তো একই ধরনের টানাপড়েন আছে। সেটা থাকাটাই ভাল। কিন্তু এত দিন পরে কেন মনে হল, ‘এটা ঠিক হচ্ছে না ভাই!’ আগেই মনে হওয়া উচিত ছিল। কারণ তৃণমূল এমন একটা দল, যারা খুব বেশি নিজেদেরকে ঢেকে রাখতে পারে না। সিপিএম অনেক দিন নিজেদেরকে ঢাকা-চাপা দিয়ে রেখেছিল। কারণ সিপিএমের একটা মতাদর্শ আছে। বিজেপিরও একটা দর্শন রয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের ভিতরে কোনও দর্শনই নেই। এটা একেবারেই একটা ওপেন প্ল্যাটফর্ম। যে পারছে আসছে। ছেড়ে যাচ্ছে। ফলে এই দলটা সম্পর্কে মোহভঙ্গ হওয়ার জন্য এতটা সময় নেওয়ার কোনও কারণ নেই।

প্রশ্ন: একটু ভেঙে বলবেন?
কৌশিক: পঞ্চায়েত নির্বাচন যখন প্রহসনে পরিণত হল, তখন রুদ্রনীলের মনে হল না এই দলটার সম্পর্কে মোহভঙ্গ হওয়া উচিত? নারদ কেলেঙ্কারির সময় গেঞ্জি পরে তোয়ালে মুড়ে যখন তৃণমূল নেতাদের টাকা নিতে দেখা গেল, তখন রুদ্রনীলের মনে হয়নি মোহভঙ্গ হওয়া উচিত? মোহভঙ্গ হতে এতটা সময় নেবে কেন! মার্কস, লেনিন— এ সব বলে মানুষকে অনেক দিন বোকা বানিয়েছে সিপিএম। তৃণমূলের তো সে সব ছিল না। তৃণমূলের একটা অংশের একটা বড় লড়াই আছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে রাতারাতি যাঁরা মাফিয়া হয়ে গেলেন, তাঁরা কারা! তাঁদের সম্পর্কে তো রুদ্রনীলের মোহভঙ্গ হওয়া উচিত ছিল।

‘‘রুদ্রনীল মোহভঙ্গ হতে এতটা সময় নেবে কেন!’’

প্রশ্ন: কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় না থাকলে কি টালিগঞ্জে কাজ পাওয়া যায় না? না হলে এত ঝোঁক কেন?
কৌশিক: আমার তেমনটা মনে হয় না। যে সমস্ত শিল্পী বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষোভ সঙ্গত। সিপিএম যে নাকটা গলায়নি, সেটা অরূপ-স্বরূপ বিশ্বাসরা এসে ভাল করে গলিয়েছেন। এটা খারাপ জায়গায় গিয়েছে। শিল্পীরা যা ভুগছে, তার থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত টেকনিশিয়ানরা। তাঁদের কে কাজ পাবেন, কে পাবেন না সেটা তৃণমূল ঠিক করে দেয়। টাকা না পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই ক্ষোভটা ছিল। কিন্তু তার সমাধান তো বিজেপিতে যাওয়া নয়।

প্রশ্ন: সমাধানটা কী?
কৌশিক: যাঁরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁদের এমন একটা ভাব, ‘এই তো আসিয়াছে পরিত্রাতা’। বিজেপি এলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। এটা ভীষণ বাজে অজুহাত। বিজেপিতে যাচ্ছেন যান। কিন্তু তিনি বিজেপিতে গেলেই ইন্ডাস্ট্রিটা পাল্টে যাবে, এটা ঠিক নয়। কারণ পাল্টাবে কারা? আজ যে শিল্পীরা দিল্লিতে গিয়ে গলায় উত্তরীয় পরে বিজেপিতে যোগ দিলেন, তাঁরা দেশ বা রাজ্যের খবরাখবর রাখেন? বিজেপি কী কী গণতন্ত্র বিরোধী কাজ করছে, কী কী তথ্য গোপন করছে, কেন্দ্রীয় সরকার কোন কোন তথ্য চেপে রাখছে— টালিগঞ্জের শিল্পীরা সেই হোমওয়ার্কটা করেছেন তো! এগুলো যদি ওঁরা জানতেন, তা হলে আমার ধারণা, বলতে পারতেন না— বিজেপি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কখনওই বলছি না, তৃণমূল স্বর্গরাজ্য করেছে। বরঞ্চ উল্টোটাই।

‘‘বিজেপিতে গেলেই ইন্ডাস্ট্রিটা পাল্টে যাবে, এটা ঠিক নয়।’’

প্রশ্ন: ওঁদের কী করা উচিত ছিল?
কৌশিক: ওঁদের উচিত ছিল বিজেপিতে না গিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া।

প্রশ্ন: এই আমরাটা কারা?
কৌশিক: আমরা, যারা অর্জুন সিংহের বিরুদ্ধেও বলি। আবার মদন মিত্রের বিরুদ্ধেও বলি।যারা একটা স্পেস তৈরি করার চেষ্টা করছি আপ্রাণ। যারা কারও হয়েই কথা বলছি না। তৃণমূল নয়, বিজেপিও নয়। শিল্পীদের তো একটা জায়গায় আসতেই হবে।

প্রশ্ন: কৌশিক, আপনি সিপিএম নন, তৃণমূল নন, বিজেপিও নন। তা হলে আপনার রাজনৈতিক পরিচয়টা ঠিক কী?
কৌশিক: আমি এবং আমরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষ। আমাদের এখানে ধারণা, রাজনৈতিক পরিচয় মানেই তুমি লাল, গেরুয়া বা সবুজ। রাজনীতি মানে তো এটা নয়। আমরা কোনও একটা দলকে ভোট দিতেই পারি। তার মানে তো আমি সেই দলটার ক্রীতদাস নই। আমি পলিটিক্যাল কথা বলব। কিন্তু কোনও পলিটিক্যাল পার্টির হয়ে কথা বলব না। যাঁরা বিজেপিতে গেলেন, তাঁদের বলি, এক বার জয়েন করে গেলে আর কিন্তু ওই দলের সমালোচনা করতে পারবেন না। পারলেও সময় লাগবে। ঠিক যেমন রুদ্রনীলের সময় লাগল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement