বাঁচার লড়াই চালাচ্ছিলেন চোদ্দো দিন ধরে। আর পারলেন না। কলকাতার এম আর বাঙুর হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ডে শনিবার রাতে মারা গেলেন তারকেশ্বরের অ্যাসিড আক্রান্ত জ্যোৎস্না দাস (৪৫)।
মদ খাওয়ার প্রতিবাদ করায় গত ২৪ জুলাই জ্যোৎস্নাদেবীর গায়ে অ্যাসিড ছোড়ার অভিযোগ ওঠে এক পড়শি যুবকের বিরুদ্ধে। অ্যাসিডে দগ্ধ হয় তাঁর মেজো ছেলে, বছর পনেরোর আনন্দও। দু’জনকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় তারকেশ্বর গ্রামীণ হাসপাতালে। জ্যোৎস্নাদেবীর মুখের ডান দিকের একাংশ ঝলসে যায়। ঠোঁট কালো হয়ে ঝুলে পড়়ে। গলা এবং পেট কার্যত ফুটো হয়ে যায়। আনন্দের হাতে-বুকে ক্ষত হয়।
তারকেশ্বর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে ওই রাতেই মা-ছেলেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দিন চারেক চিকিৎসার পরে আনন্দ কিছুটা সুস্থ হলেও জ্যোৎস্নাদেবীর সংক্রমণ এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে তা চিকিৎসার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে পরিবারের লোকজনকে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ডাক্তারদের কথামতোই জ্যোৎস্নাদেবীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরের দিনই তাঁকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শনিবার রাতে তিনি মারা যান।
গত সপ্তাহে জ্যোৎস্নাদেবীর বাড়ি গিয়েছেলেন হুগলি জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সচিব সৌনক মুখোপাধ্যায়। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, জ্যোৎস্নাদেবীর চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব রাজ্য সরকার নেবে। কিন্তু কোনও সাহায্যই আর কাজে লাগল না!
জ্যোৎস্নাদেবীর বড় ছেলে রাজা পঞ্জাবে সোনার কাজ করেন। মা-ভাইয়ের উপরে অ্যাসিড-হামলার কথা শুনে তিনি ফিরে আসেন। রবিবার তিনি অভিযুক্তের কঠিন শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘‘আমরা অনাথ হয়ে গেলাম। মা চোখেও দেখতে পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছে ভাইকেও আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ওর সংক্রমণও বাড়ছে।’’ ওই পরিবারকে লড়াই না ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন জয়নগরের অ্যাসিড আক্রান্ত মনীষা পৈলান। তিনি বলেন, ‘‘জ্যোৎস্নাদেবীর আত্মীয়দের বলেছি, লড়াই থামাবেন না। আমি পাশে আছি।’’ কিছু দিন আগেই ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও তাঁর অভিযুক্ত প্রাক্তন স্বামীকে গ্রেফতার করার দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন মনীষা। কেন তাঁর ক্ষতিপূরণ পেতে দেরি হচ্ছে সেই প্রশ্ন তুলে তখন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল হাইকোর্ট।
তারকেশ্বরের পিয়াসারা কলোনির বাসিন্দা ছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী। স্বামী মারা গিয়েছেন মাস সাতেক আগে। তিন ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে কোনও মতে সংসার চালাচ্ছিলেন। ২৪ জুলাই মাঝরাতে বাড়ির দরজায় ইট-পাটকেল পড়ার আওয়াজে কী হচ্ছে দেখতে বাইরে বেরোতেই জ্যোৎস্নাদেবীর মুখে অ্যা়সিড ছোড়া হয়। মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছিল আনন্দ। সে-ও জখম হয়। মা-দাদার চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে পড়ে জ্যোৎস্নাদেবীর ছোট ছেলে রাকেশ। বাইরে এসে সে প্রতিবেশী শেখ নুর আলিকে ছুটে পালাতে দেখে। তার বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশ শেখ নুর আলিকে গ্রেফতার করেছে।
অভিযোগে জ্যোৎস্নাদেবী জানিয়েছিলেন, দলবল নিয়ে নুর আলি প্রায়ই তাঁর বাড়ির সামনে মদ খেয়ে গালিগালাজ করত। প্রতিবাদ করায় শুনতে হতো হুমকি। ভয় পেয়ে তিনি এলাকার তৃণমূল নেতাদের জানিয়েছিলেন। তারপরে হুমকির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জ্যোৎস্নাদেবী বলেছিলেন, ‘‘মদ খাওয়ার প্রতিবাদ করেছিলাম। সে জন্য ওরা দলবল নিয়ে হুমকি দিচ্ছিল। কিন্তু এমন ক্ষতি করে দেবে, ভাবিনি।’’
জ্যোৎস্নাদেবীর মৃত্যুর খবর গ্রামে পৌঁছতেই এ দিন পড়শিরা ওই বাড়িতে ভিড় করেন। তবে, অভিযুক্ত নুর আলির বাড়ি ছিল তালাবন্ধ। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, খুনের চেষ্টার অভিযোগে নুরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ বার ওই মামলার সঙ্গে তার বিরুদ্ধে খুনের মামলাও রুজু করা হবে।