টিনের চালার নীচে খান তিনেক অপরিসর ঘর— ডায়মন্ডহারবারের পরিচিত এক ‘মাতৃ সদন’। তবে, সেখানে জন্মানো অধিকাংশ শিশুর শংসাপত্র মিলছে কল্যাণী পুরসভা থেকে। কেন?
পাক্কা এগারো মাস ধরে, সে উত্তরটাই হাতড়েছে ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’, সংক্ষেপে ‘কারা’। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ— সতেরোটা জেলার আনাচ কানাচ ঢুঁড়ে, এমনই বেশ কয়েকটি না-মেলা প্রশ্ন এবং তার উত্তর সাজিয়ে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট দিয়েছে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা। যার সার কথা— অসহায়-অনাথ শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার অছিলায় শিশু বিকিকিনির ‘হাট’ খুলে বসেছে ওই সংগঠনগুলি।
কারা-র রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং জলপাইগুড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় এমন কিছু নার্সিংহোম রয়েছে আদতে যেগুলি শিশু বিকিকিনির আঁতুরঘর। জন্মের পরে, আটপৌরে সেই সব নার্সিংহোম থেকে দত্তক দেওয়ার আড়ালে সরাসরি সেই শিশু বিকিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। তাদের জন্মের শংসাপত্রও রয়েছে, তবে ডায়মন্ড হারবারের শিশু নথিবদ্ধ হচ্ছে কল্যাণী পুরসভায়। মালদহের গাজোল নার্সিংহোমে জন্ম নেওয়া সদ্যোজাতের শংসাপত্র তুলে দিচ্ছে জলপাইগুড়ি পুরসভা। শিশু বিকিকিনির এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কল্যাণী বা জলপাইগুড়ির ওই সব নার্সিংহোম পুরসভার কাছে যে নথি দাখিল করছে, তাতে প্রশ্ন তোলার কোনও সুযোই পাচ্ছে না ওই পুরসভাগুলি।
শিশু বেচাকেনা রুখতে বছর দশেক ধরে দেশের প্রান্তিক এলাকা ঘুরে কাজ করছে মহারাষ্ট্রের একটি সংগঠন, ‘যতন’। যার সম্পাদিকা পল্লবী খার বলছেন, ‘‘প্রত্যন্ত সব গ্রামে পৌঁছে গিয়েছে ওই সব সংস্থার দালালেরা। খোঁজ করছে অবাঞ্ছিত সন্তান কিংবা নিতান্তই দুঃস্থ পরিবারের অন্তঃসত্ত্বাদের। যাদের বোঝানো হচ্ছে, শিশু জন্মানোর যাবতীয় খরচ দেওয়া হবে তাদের তরফে। শর্ত একটাই, সদ্যোজাতটিকে তুলে দিতে হবে তাদের হাতে। বিনিময়ে মিলবে হাজার কয়েক টাকা।’’
জলপাইগুড়ির ‘আশ্রয়’ হোমের ঘটনা নিছকই একটা উদাহরণ। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের হাতে তুলে দেওয়া কারা-র সদ্য প্রকাশিত ওই রিপোর্ট বলছে— দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মালদহ কিংবা কলকাতার শহরতলিতে শিশু-বিকিকিনির ঢালাও ব্যবসা ফেঁদেছে এমন বেশ কয়েকটি সংস্থা যারা, বিদেশে শিশু পাচারেও দিব্যি হাত পাকিয়েছে। বলাই বাহুল্য, শিশু বিক্রির সেই ব্যবসায়, কারা তো বটেই, ‘স্টেট অ্যাডাপশন রিসোর্স এজেন্সি’র (সারা) নিয়মকানুনও তোয়াক্কা করছে না ওই সংগঠনগুলি।
কারা-র এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, ‘‘মনে রাখবেন, দত্তক দেওয়ার আড়ালে শিশু পাচারের তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।’’
নিয়ম অনুসারে, শিশু দত্তক নিতে হলে, ‘কারা’ কিংবা ‘সারা’, দুই সরকারি সংস্থার কাছে অনলাইনে আবেদন করাই দস্তুর। এর পর, দুই সংস্থার তালিকাভুক্ত সংগঠনগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, আবেদনকারীর সামাজিক অবস্থান, পরিবার এমনকী পাড়া-পড়শির সঙ্গে সম্পর্ক— যাবতীয় তথ্য খুঁটিয়ে দেখার। দত্তক দেওয়ার এটাই প্রাথমিক রীতি। কিন্তু, সে রীতি মানছে কে?