Kanchanjunga Express Accident

ফাঁসিদেওয়ার ‘ময়নাতদন্ত’: রেলের দাবি মিলছে না, দুর্ঘটনার কারণ যা-ই হোক, প্রশ্নের মুখে পরিকাঠামোই

রেলকর্মীদের একাংশের মতে, যে হেতু ঘণ্টাতিনেক ধরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ ছিল, তাই এ ক্ষেত্রে ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’-এ ট্রেন চালানো উচিত ছিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৪ ২১:৫৪
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

উত্তরবঙ্গের ট্রেন দুর্ঘটনায় জখম এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে মঙ্গলবার। এখনও পর্যন্ত ওই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১০। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করছে বুধবার। তবে তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই রেলের তরফে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মালগাড়ির চালকের ‘ভুলের’ দিকে। দুর্ঘটনার দিনই, অর্থাৎ সোমবার রেলের তরফে একাধিক কর্তা অভিযোগ করেছিলেন, মালগাড়ির চালক সিগন্যাল মানেননি। মঙ্গলবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। রেলের প্রাক্তন কর্তাদের অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কী ভাবে তদন্তের আগেই এমন মন্তব্য করা হচ্ছে? রেলকর্মীদের একাংশ দাবি করেছেন, যে ‘কাগুজে সিগন্যাল’ রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার দিয়েছিলেন মালগাড়ির চালককে, সেখানে গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের কথা লেখা ছিল না। ওই লাইনে যে মালগাড়ির আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস রয়েছে, তা লিখিত ভাবে মালগাড়ির চালককে জানানোর কোনও নথিও এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে ওই অংশের দাবি। প্রাক্তন এবং বর্তমান রেলকর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, এই দুর্ঘটনার নেপথ্যে কোথাও একটা সমন্বয়গত ত্রুটি রয়েছে। সব মিলিয়ে এই দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে রেলের পরিকাঠামোকেই দায়ী করছেন তাঁরা।

Advertisement

রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার ভোর প্রায় সাড়ে ৫টা থেকে ‘অকেজো’ ছিল রাঙাপানি এবং চটেরহাটের মধ্যেকার স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ‘কাগুজে অনুমতি’ দেওয়া হচ্ছিল ট্রেনচালক ও ট্রেন ম্যানেজার (গার্ড)দের। রেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট’ (পিএলসিটি)। রেলের একটি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, দুর্ঘটনার আগে রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির চালক ও গার্ডকে আলাদা আলাদা ভাবে ‘টিএ-৯১২ ফর্ম’ দেন। ফর্ম দু’টিতে একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল, কোন কোন সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও ‘ভাঙতে’ পারবেন চালক। এমনকি, কোথা থেকে কোন অবধি এই ‘অনুমতি’ বহাল থাকবে, তারও উল্লেখ ছিল। প্রাক্তন রেলকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, লাল সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও নিয়ম ভেঙে মালগাড়ির চালক ট্রেন চালিয়েছিলেন, এমনটা সঠিক নয়। কারণ, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা ‘অকেজো’ থাকায় সিগন্যাল লাল থাকা অবস্থাতেই ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল মালগাড়ির চালককে। সেটা দিয়েছিলেন রাঙাপানির স্টেশনমাস্টারই। একই নির্দেশ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জন্যও।

উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মধ্যে একমাত্র কাটিহার ডিভিশনেই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে বলে রেলের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে। এই পদ্ধতি চালু হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। শুরু হয়েছিল আমবাড়ি থেকে রাঙাপানি পর্যন্ত। পরে আলুয়াবাড়ি পর্যন্ত তা করা হয়। আমবাড়ি থেকে আলুয়াবাড়ি পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা গত ছয় মাস ধরে কাজ করছে বলেই ওই সূত্রের দাবি। তবে রেলকর্মীদের একাংশের মতে, নতুন পদ্ধতি চালু হলেও হয়তো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ হয়নি। সে কারণেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ‘বিপর্যয়ের মুখোমুখি’ হতে হয়েছে সোমবার। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা ‘অকেজো’ হলে কোন নিয়মে ট্রেন চলাচল করবে, তা নিয়ে সমন্বয়ের অভাব ছিল বলেও মনে করছেন ওই অংশের কর্মীরা। রেলের দাবি, প্রতি তিন বছর অন্তর ট্রেনচালক, ট্রেন ম্যানেজার-সহ বিভিন্ন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ট্রান্সপোর্টেশন রিফ্রেশার ট্রেনিং’। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে অনেক জায়গাতেই কাজ চালানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন হয়। রেলকর্মীদের ওই অংশের প্রশ্ন, বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হলেও সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণে কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে না তো?

Advertisement

বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে যেমন ‘এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল’ (এটিসি) বড় ভূমিকা নেয়, তেমনই ট্রেন পরিষেবার ক্ষেত্রে ‘কন্ট্রোল রুম’ সেই দায়িত্ব পালন করে। কোন ট্রেন কোন লাইন দিয়ে কখন যাবে, কোন ট্রেনকে আগে পাস করানো হবে, কোন ট্রেন আটকে দেওয়া হবে, আটকালেও কত ক্ষণে তা গন্তব্যে রওনা দেবে, তা সবই ঠিক করে কন্ট্রোল রুম। বিভিন্ন স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের মাধ্যমেই কন্ট্রোল রুম এই কাজ করে থাকে। কিন্তু ট্রেন চলাচল সংক্রান্ত গোটা বিষয়টিই কার্যকর হয় স্টেশনমাস্টার, ট্রেন চালক এবং গার্ডের মাধ্যমে। রেলের প্রাক্তন কর্মীদের অনেকেরই বক্তব্য, নতুন নতুন যে সব নিয়ম বা পদ্ধতি আনা হয় রেলে, কন্ট্রোল রুমের কর্মীদেরও সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। যাতে ‘কন্ট্রোলার’রা প্রয়োজনে স্টেশনমাস্টারকে ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’তে সাহায্য করতে পারেন। রেল যদিও দাবি করেছে, সব সময়েই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সকল কর্মীকে। এক রেলকর্তার কথায়, ‘‘নিয়মিত সকল কর্মীর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কোথাও কোনও খামতি নেই।’’

রেলকর্মীদের একাংশ অন্য একটি বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, রাঙাপানির স্টেশনমাস্টার সিগন্যাল সংক্রান্ত যে ‘অনুমতিপত্র’ দিয়েছিলেন সেটি ‘টি/এ ৯১২’ ফর্মে। নিয়ম অনুযায়ী, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকলে এই ফর্মটি স্টেশনমাস্টারের দেওয়ারই কথা। এই ফর্মে লেখা থাকে, কোথা থেকে কোন পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল খারাপ রয়েছে। কোন কোন সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও চালক গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন সে কথাও স্টেশনমাস্টার লিখে দেন ওই ফর্মে। ওই পথে যদি কোনও লেভেল ক্রসিং থাকে, সেখানকার রেল গেট বন্ধ আছে কি না তা দেখেই চালককে গাড়ি চালানোর কথা বলা হয়। এ ক্ষেত্রেও রাঙাপানির স্টেশনমাস্টার সে সব উল্লেখ করেছিলেন ‘টি/এ ৯১২’ ফর্মে। রেলকর্মীদের একাংশের দাবি, যে ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দেওয়া হয়েছিল চালক-গার্ডদের, সেখানে ট্রেন কত গতিতে চালাতে হবে, সেই সংক্রান্ত নির্দেশ কোথাও লেখা ছিল না। তাঁদের মতে, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ, সেখানে ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দেওয়া ঠিক হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে দিতে হত ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্ম। ওই ফর্মে লেখা থাকে, কোন কোন সিগন্যাল খারাপ, কোন কোন সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও চালক তা উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন ইত্যাদি নির্দেশ। একই সঙ্গে ওই ফর্মে লেখা থাকে, ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’-এর কথা। যখন স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকে এবং সেই ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে বাতিল করে কাগুজে সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রেন চালানো হয়, শুধু তাই নয়, দুই স্টেশনমাস্টারের মধ্যে একটি ‘প্রাইভেট নম্বর’ বিনিময় করে একটি লাইনে একই সময়ে দু’টি স্টেশনের মধ্যে কেবলমাত্র একটি ট্রেনই চালানো হয়, তাকেই বলা হয় ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’। এ ক্ষেত্রে ট্রেন সর্বাধিক ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে চালানো যায়। সেটাও নিশ্চিত করা হয় ওই ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্মের মাধ্যমে। ওই রেলকর্মীদের আরও বক্তব্য, শুধুমাত্র ‘টি/এ ৯১২’ কোনও ভাবেই ‘অথরিটি টু প্রসিড’, অর্থাৎ ট্রেন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতিপত্র হতে পারে না। ‘টি/ডি ৯১২’ই একমাত্র সেই অনুমতিপত্র হতে পারে।

কিন্তু সোমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস বা মালগাড়ির ক্ষেত্রে ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্ম দেওয়া হয়নি বলেই দাবি রেলকর্মীদের একাংশের। দুর্ঘটনার পর যে সব নথি সামনে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, রাঙাপানির স্টেশনমাস্টার ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন চালকদের। সেই নথিতে দেখা যাচ্ছে, স্টেশনমাস্টার লিখেছেন, রাঙাপানি থেকে চটেরহাট পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল খারাপ আছে। ওই পথে মোট ৯টি লাল সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও ট্রেন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি তিনি দিয়েছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির চালককে। স্টেশনমাস্টারের নথিতে বলা হয়েছিল, এ৫-৬৫৪, এ৫-৬৫২, এ৫-৬৫০, এ৫-৬৪৮, এ৫-৬৪৬, এ৫-৬৪৪, এ৫-৬৪২, এ৫-৬৪০ এবং এ৫-৬৩৮ সিগন্যাল খোলা থাকলেও তা অতিক্রম করা যাবে। ওই অনুমতিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, চালককে অবশ্যই নজর রাখতে হবে যাত্রাপথের লেভেলক্রসিং গেটের উপর। যদি গেট বন্ধ থাকে, তবেই ট্রেন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন চালক। গেট খোলা থাকলে তার আগেই ট্রেন থামিয়ে দিতে হবে। তার পর সবটা দেখেশুনে এগোতে হবে ট্রেন নিয়ে।

কিন্তু ওই নথিতে কোথাও বলা ছিল না, কত কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালাতে হবে! একই সঙ্গে অনুল্লেখিত ছিল, ওই মালগাড়ির ১৫ মিনিট আগেই রাঙাপানি স্টেশন থেকে ‘কাগুজে সিগন্যাল’ নিয়ে ছেড়ে গিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। পূর্ব রেলে দীর্ঘ দিন ট্রেনচালক হিসাবে কাজ করা এক প্রাক্তন রেলকর্মীর কথায়, ‘‘যেটুকু জানতে পেরেছি, চালকদের ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন স্টেশনমাস্টার। এ ক্ষেত্রে যে হেতু দীর্ঘ সময় ধরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ ছিল, তাই ওই ফর্ম নয়, দেওয়া উচিত ছিল ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্ম। কেন সেই ফর্ম দেওয়া হয়নি, সেটা দেখে অবাকই হচ্ছি। নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। সিস্টেমের মধ্যে না থেকে এটা নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’’

তিনি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, রেলের অভ্যন্তরীণ সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্ম দেওয়া হয়। যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই না-থাকে, তা হলে দিতে হয় ‘টি/বি ৯১২’ ফর্ম। প্রাক্তন ওই ট্রেনচালকের কথায়, ‘‘শুধুমাত্র ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দেওয়া যায় না কখনও। তার সঙ্গে অন্যান্য কাগজপত্র দিতে হয়। যেগুলোকে রেলের পরিভাষায় ‘অ্যামেন্ডমেন্ট’ (সংশোধনী) বলে। এ ক্ষেত্রে সেই সংক্রান্ত কোনও নথি দেওয়া হয়েছিল কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।’’ একই সঙ্গে রেলকর্মীদের একাংশের দাবি, যে হেতু ঘণ্টা তিনেক ধরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল খারাপ ছিল, তাই এ ক্ষেত্রে ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’-এ ট্রেন চলানো উচিত ছিল। অর্থাৎ পরের স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের কাছ থেকে একটি ‘প্রাইভেট নম্বর’ নিয়ে ট্রেন চালাতে হত। একটি লাইনে সেই সময়ে দু’টি স্টেশনের মধ্যে কেবলমাত্র একটি ট্রেনই থাকা উচিত নিয়ম অনুযায়ী। সেটাও লেখার জায়গা থাকে ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্মে। স্টেশনমাস্টার কেন সেই ফর্ম দেননি, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।

রেলকর্মীদের অন্য একটা অংশের দাবি, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থায় একটি ট্রেন কোনও সবুজ সিগন্যাল পার করে যাওয়া মাত্রই সেটি লাল হয়ে যায়। সেটি পরের সিগন্যাল পার হলেই আগের সিগন্যালটি হলুদ হয়। তার পরেরটি অতিক্রম করলে দু’টি হলুদ এবং তার পরেরটিও পার হলে প্রথম সিগন্যালটি সবুজ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যদি কোনও চালক একটি সিগন্যাল লাল দেখেন, তা হলে তিনি দিনের বেলা ১ মিনিট দাঁড়িয়ে ট্রেন নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে পারেন। রাতের বেলা দাঁড়াতে হবে ২ মিনিট। তবে খেয়াল রাখতে হবে সামনে কোনও বাধা আছে কি না! সে ক্ষেত্রে গতিবেগ রাখতে হবে দিনের বেলা ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার। রাতে ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকলে ‘কাগুজে অনুমতি’ নিয়েই চালককে ট্রেন চালাতে হয়। ওই ‘কাগুজে সিগন্যালেই’ তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়, লাল সিগন্যাল উপেক্ষা করা যাবে। সোমবারের ক্ষেত্রে যা দেওয়া হয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মালগাড়ির চালক-গার্ডকে। তবে ওই নির্দেশনামার ‘ফর্ম’ ঠিক ছিল না বলেই রেলকর্মীদের একাংশ অভিযোগ তুলেছেন। যদিও এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কোনও জবাব দিতে চাননি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার জনককুমার গর্গ। তিনিই এই দুর্ঘটনার তদন্ত করছেন। জনক বলেন, ‘‘তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না।’’

এ ছাড়াও পরিকাঠামো সংক্রান্ত যে সব প্রশ্ন উঠছে—

পুরনো আইসিএফ কোচ

২০১৭ সালেই রেল দুর্ঘটনা এড়াতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ট্রেনের কামরা বদল করা। রেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুরনো প্রযুক্তির কামরা তৈরি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ওই ধরনের কামরা তৈরি হয় চেন্নাইয়ের ‘ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি’তে। ফ্যাক্টরির নামেই কামরার নাম— আইসিএফ। রেল বোর্ড ২০১৭ সালে জানিয়ে দেয়, দেশের সব ট্রেনেই ধীরে ধীরে পুরনো আইসিএফ কামরা পাল্টে এলএইচবি (লিঙ্ক হফম্যান বুশ) প্রযুক্তির উন্নত কামরা লাগানো হবে। এলএইচবি হল জার্মানির লিঙ্ক হফম্যান বুশ প্রযুক্তিতে তৈরি কামরা। এই ধরনের কামরার ভারসাম্য অনেক বেশি। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গতি বৃদ্ধির ক্ষমতা রাখে। তবে গতি বাড়লেও ভারসাম্য নষ্ট হয় না। এক্সপ্রেস বা উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেনের ক্ষেত্রে তাই এই ধরনের কামরাই উপযুক্ত। দুর্ঘটনা এড়ানোর ক্ষেত্রেও। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে পুরনো কামরাই ছিল।

সুরক্ষিত ‘কবচ’ ছিল না

কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি ‘কবচ’ ছিল না ওই লাইনে? কবচ ভারতে তৈরি একটি প্রযুক্তি। একই লাইনে দু’টি ট্রেন চললে দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে কবচ। কবচ আসলে কী? অনেকেরই বিশ্বাস, শরীরে কবচ ধারণ করলে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি মেলে। তেমনই লাইনে কবচ লাগানো থাকলেও এড়ানো সম্ভব দুর্ঘটনা। কবচ হল অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন (এটিপি) সিস্টেম। তিনটি ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে মিলে এই প্রযুক্তি তৈরি করেছে রিসার্চ ডিজ়াইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজ়েশন (আরএসসিও)। ২০২০ সালে কবচকে জাতীয় স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ সুরক্ষা স্তরের পরীক্ষাতেও সবুজ সঙ্কেত পায় এই প্রযুক্তি। এটি ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। এর ফলে দৃশ্যমানতা কম থাকলেও চলতে পারে ট্রেন। মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। চালককে সতর্ক করে দেয়। দুর্ঘটনার পর রেল বোর্ড স্বীকার করে নিয়েছে, ওই লাইনে ছিল না ‘কবচ’। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান জয়া বর্মা সিংহ বলেছেন, ‘‘দিল্লি-গুয়াহাটি রুটে সুরক্ষা ব্যবস্থা বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে রেলের।’’

সব মিলিয়ে রেলের প্রাক্তন এবং বর্তমান কর্মীদের একটা বড় অংশ মেনে নিচ্ছেন, পরিকাঠামোগত সমস্যাতেই ভুগছে রেল। তার প্রভাবেই যে সোমবারের এই দুর্ঘটনা, তা-ও মেনে নিচ্ছেন তাঁদের অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement