টোল চাইছিস এত সাহস! আয়েশ করে জুতো পিটিয়ে তড়পালেন আবু

ভরদুপুরে ডানকুনি টোল প্লাজার কর্মীদের বেদম জুতোপেটা করছেন এক তৃণমূল নেতা। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। প্রচণ্ড রাগে জুতো ছুড়ে ছুড়েও মারছেন। সেই জুতো কুড়িয়ে আনছেন তাঁর গাড়ির চালক। নেতা ফের জুতো হাতে তুলে নিচ্ছেন। পেটাতে পেটাতে আর কী বলছেন নেতা? বলছেন, “কাকে আটকাচ্ছিস জানিস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে!’’

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল

ডানকুনি শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪২
Share:

ভরদুপুরে ডানকুনি টোল প্লাজার কর্মীদের বেদম জুতোপেটা করছেন এক তৃণমূল নেতা। মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। প্রচণ্ড রাগে জুতো ছুড়ে ছুড়েও মারছেন। সেই জুতো কুড়িয়ে আনছেন তাঁর গাড়ির চালক। নেতা ফের জুতো হাতে তুলে নিচ্ছেন।

Advertisement

পেটাতে পেটাতে আর কী বলছেন নেতা? বলছেন, “কাকে আটকাচ্ছিস জানিস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে!’’

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওই টোল প্লাজার কর্মীদের অপরাধ, ৫০ টাকা টোল নেওয়ার জন্য নেতাটির গাড়ি আটকেছিলেন তাঁরা। রবিবার দুপুরে তাতেই নাকি ক্ষেপে ওঠেন রাজ্য সংখ্যালঘু বিত্ত উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল নেতা আবু আয়েশ মণ্ডল। অভিযোগ, প্রথমে তিনি গালিগালাজ শুরু করেন, তার পর জুতোপেটা। টহলদার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি সামলালেও রণং দেহি নেতার বিরুদ্ধে রাত পর্যন্ত তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

Advertisement

মাত্র ক’দিন আগে মালদহের ইংরেজবাজারে বিদ্যুৎ দফতরের এক অফিসারকে কলার ধরে চড় মারতে গিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় ওরফে বুলেট। আবু আয়েশের এ দিনের কীর্তি সেই গুন্ডামিকেও ছাপিয়ে গেল বলে মনে করছেন অনেকেই। আবু আয়েশের দাবি, ‘সব বানানো ঘটনা’। যদিও টোল প্লাজার কর্মীরা বলেছেন, গোটা ঘটনাটি সিসিটিভি ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে। পুলিশ চাইলেই ফুটেজ দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, ওই টোল প্লাজার কর্মী সংগঠন তৃণমূল প্রভাবিত। কর্মীদের পক্ষ থেকে ডানকুনি থানায় আবু আয়েশের বিরুদ্ধে নিগ্রহের লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

ঘটনার কথা জানতে পেরে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তৃণমূলের অন্দরেই। শীর্ষ নেতৃত্বও অস্বস্তিতে। একান্তে অনেকেই বলেছেন, দলের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন আবু আয়েশ। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “অভিযোগ পেলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এক সময়ে সিপিএমের টিকিটে সাংসদ ও বিধায়ক হয়েছিলেন আবু আয়েশ। রাজ্যে পালাবদলের আগেই তৃণমূলে আসেন। টোল প্লাজা কর্মীদের দাবি উড়িয়ে দিয়ে তিনি এ দিন বলেছেন, “ওঁদের কোন ভূতে ধরেছে, সেটা ওঁরাই বলতে পারবেন। ওঁরা মাঝেমধ্যেই আমার গাড়ি আটকে হেনস্থা করেন। এ দিনও তা-ই করলেন। আমি বলেছিলাম টোল দেব। কিন্তু শুনলেন না। আমি ডানকুনি থানাতে ফোন করি। এক বিধায়ককেও জানিয়েছি।”

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন দুপুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কলকাতা থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন আবু আয়েশ। সওয়া ১টা নাগাদ তাঁর গাড়িটি ডানকুনি টোল প্লাজায় ঢোকে। পদাধিকার-বলে যাঁরা টোল দেওয়া থেকে ছাড় পান, তাঁদের গাড়ির জন্য টোল প্লাজার এক ধারে আলাদা লেন রয়েছে। আবু আয়েশের গাড়িটি সেই লেন ধরে বেরিয়ে যেতে গেলে সেটিকে আটকানো হয়। কর্মীরা সওয়ারির পরিচয় জানতে চান। অভিযোগ, তখনই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন আবু আয়েশ।

গালাগালি দিয়ে শুরু, তার পর পা থেকে জুতো খোলেন আবু আয়েশ। কর্মীদের জুতোপেটা করা হচ্ছে শুনে ছুটে আসেন টোল প্লাজার শিফট ইনচার্জ বিকাশ চৌধুরী। অভিযোগ, তিনি আবু আয়েশকে নিরস্ত করতে গেলে ‘তুই আগেও এমন করেছিস’ বলে তাঁকেও জুতো মারতে থাকেন তৃণমূল নেতা। সেই সময়েই নেতার গাড়ির চালক একাধিক বার তাঁর জুতো কুড়িয়ে এনেছেন বলে অভিযোগ সোমেশ্বর চৌধুরী নামে এক কর্মীর।

শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলায় কাছেই থাকা ডানকুনি থানার টহলদার পুলিশ। কোনও রকমে আবু আয়েশকে শান্ত করিয়ে বর্ধমান রওনা করিয়ে দেয় তারা। তবে সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনাস্থলে পৌঁছেও পুলিশ আবু আয়েশকে সঙ্গে সঙ্গে যেতে দিল কেন? হুগলি জেলা পুলিশের এক কর্তার যুক্তি, “পুলিশ যখন আসে, সেই সময় তো কেউ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে কী করে?” তবে তিনি জানান, তদন্ত শুরু হয়েছে। টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হবে।

জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের থেকে বরাত পেয়ে টোল প্লাজাটি চালায় একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা জানিয়েছে, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয়

সরকারের মোট ২৬টি পদের আধিকারিকদের গাড়ি থেকে নিয়ম মতো ‘টোল’ নেওয়া হয় না। সেই তালিকায় আবু আয়েশ মণ্ডল পড়ছেন না। ওই ২৬টি পদের অধিকারী ছাড়া সকলেরই, এমনকী বিধায়কদেরও ‘টোল’ দেওয়ার কথা। তাই এ দিন ওই তৃণমূল নেতার থেকে ‘টোল’ চেয়ে কোনও অন্যায় হয়নি বলে টোল প্লাজার কর্মীদের দাবি। তাঁরা জানান, আবু আয়েশের গাড়িতে লাল-নীল কোনও বাতি ছিল না। তা সত্ত্বেও সেটি পাশের লেন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন, গাড়িতে কে রয়েছেন। অশান্তি শুরু সেখানেই।

টোল প্লাজা চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ভূষণ চক্রদেও বলেন, ‘‘পুলিশ সময় মতো না এলে কর্মীরা আরও মার খেতেন। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব জানিয়েছি।’’ টোল প্লাজার তৃণমূল প্রভাবিত কর্মী সংগঠনের সভাপতি সুবীর মুখোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ মহলে আবু আয়েশের বিরুদ্ধে মুখ খুললেও সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, “বিষয়টি দলীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলব না।’’

গত বছর নিবেদিতা সেতুতে শাসক দলের শ্রমিক নেত্রী দোলা সেনের বিরুদ্ধে কর্তব্যরত কর্মীকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ভাইপোর বিরুদ্ধেও। এ দিনের ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধে জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি স্বপন পাল বলেন, “নির্লজ্জ ভাবে দাদাগিরি শুরু করেছেন শাসক দলের কিছু নেতা। এঁদের শাস্তি হওয়া দরকার। মুখ্যমন্ত্রী শাস্তি দেবেন তো!”

ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এঁরা যে সব কাণ্ড করছেন, ভাবা যাচ্ছে না। ওঁর শাস্তি দাবি করছি।” ডানকুনি টোল প্লাজার শিফট ইনচার্জ বিকাশ চৌধুরী প্রাক্তন সেনাকর্মী। বলেন, ‘‘উনি যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে খারাপ ছেলেরাও লজ্জা পাবেন। সেনাবাহিনীতে দেশের সেবা করে এসে এখন জুতোপেটা খাচ্ছি, এটা মানতে পারছি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement