(বাঁ দিকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুব্রত বক্সী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
দলীয় স্তরে বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদমাধ্যম সামলানোর দায়িত্ব পালন করত তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতর। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ডের অভিঘাতে সেই দায়িত্ব থেকে ক্যামাক স্ট্রিট নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। শুক্রবার তৃণমূল সূত্রে তেমনই খবর। শাসকদল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বার থেকে সেই কাজ করবে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর দফতর। যা তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে আবার ‘দূরত্ব’-এর সূচক বলেই মনে করছেন শাসকদলের প্রথম সারির নেতারা।
তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, গোটা বিষয়টি সম্পর্কে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অবহিত। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, আগামী দু’-তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে মমতা নিজে বৈঠক করে ‘মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা দিয়ে দেবেন। সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার থেকেই অভিষেকের দফতর সংবাদমাধ্যম সামলানোর কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।
জাতীয় বা রাজ্য স্তরে কোনও বড় ঘটনা ঘটলে দলের কোন মুখপাত্র প্রতিক্রিয়া দেবেন, তা ঠিক করত অভিষেকের দফতর। চ্যানেলে চ্যানেলে বিভিন্ন বিতর্কে কারা যাবেন, তা-ও ঠিক করে দিত ক্যামাক স্ট্রিটই। সেই প্রতিক্রিয়ায় ‘পার্টি লাইন’ কী হবে, তা-ও নির্ধারিত করত অভিষেকের দফতরই। লক্ষ্য একটাই: যাতে একই সুরে সকলে কথা বলেন। যেমন সিপিএমে হয়। কোনও বিশেষ ঘটনায় পলিটব্যুরো থেকে এরিয়া কমিটি পর্যন্ত সকলের বয়ান একই হয়। কিন্তু আরজি কর পরিস্থিতি চলতে চলতেই সেই কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল অভিষেকের দফতর। যা তৃণমূলের মধ্যে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সংগঠন থেকে অভিষেকের ‘সাময়িক বিরতি’ নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল দলে। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তৃণমূলের অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন, ‘‘২১ জুলাইয়ের মঞ্চে অভিষেক থাকবেন তো?’’ বার্ষিক সমাবেশের প্রস্তুতি পর্বে অভিষেকের ‘সরে থাকা’ নিয়েও কম চর্চা হয়নি শাসকদলের মধ্যে। তবে সমাবেশে অভিষেক শুধু উপস্থিত ছিলেন তা-ই নয়, বক্তৃতা থেকে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন সংগঠনের রাশ তাঁর হাতেই। তিন মাসের মধ্যে সংগঠনে এবং স্থানীয় প্রশাসনে রদবদলের বার্তাও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ডের আবহে অভিষেকের দফতরের সংবাদমাধ্যম সংক্রান্ত দায়িত্ব ছাড়া নতুন পর্বের ইঙ্গিত কি না, তা নিয়ে দলের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
অভিষেক-ঘনিষ্ঠেরা অনেক দিন ধরেই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, সেনাপতি প্রশাসনের অনেক কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, অভিষেক মনে করেন, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে জিততে হলে এখন থেকেই ‘প্রশাসনিক সংস্কার’ দরকার। তা না হলে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সংগঠন দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে না। উল্লেখ্য, গত বছর নভেম্বর থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অভিষেকের ‘দূরে সরে থাকা’ নিয়েও তৃণমূল আন্দোলিত হয়েছিল। আরজি কর-কাণ্ডের আবহে অভিষেকের দফতরের এই সিদ্ধান্তে তৃণমূলের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তা হলে কি দলের সেনাপতি পুলিশ তথা প্রশাসনের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। উল্লেখ্য, আরজি কর হাসপাতালে বুধবার রাতে হামলার পর অভিষেক নিজে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। দাবি জানিয়েছিলেন দল, রং না দেখে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে। বলেছিলেন, চিকিৎসকদের দাবি ন্যায্য। তাঁদের আন্দোলনও সঙ্গত। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা আশা করতেই পারেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়। একজন ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে তিনি সেই দাবি জানাচ্ছেন। সে কথা এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে ওই রাতেই পোস্ট করেছিলেন অভিষেক।
শুক্রবার সকালে যে পোস্টে কলকাতা পুলিশ জানায় আরজি করে হামলার ঘটনায় ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই পোস্টটি ‘রিপোস্ট’ করেন অভিষেক। তাঁর অনুগামীরা পুরনো পোস্ট এবং রিপোস্টের স্ক্রিনশটও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমাজমাধ্যমে। যাতে বুধবার রাতের পোস্টে ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে’ অংশটি বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। সেটিও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কারণ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় ধরপাকড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে অভিষেকের দফতর সংবাদমাধ্যম সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর তৃণমূলে এখন আলোচ্য বিষয় একটাই— এর পর কী হবে?