(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
একশো দিনের কাজ করা পশ্চিমবঙ্গের ২১ লক্ষ শ্রমিকের বকেয়া টাকা রাজ্যই মেটাবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘোষণাকে রবিবার বিজেপির তৈরি করা ‘আর্থিক সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে লড়াই বলে দাবি করল তৃণমূল কংগ্রেস। পাশাপাশি, রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ খরচের শংসাপত্র (ইউসি) না দেওয়ার যে অভিযোগ করেছিল সিএজি, সেই সংক্রান্ত দায় ফের বামেদের উপরে চাপিয়েছে তারা। বিরোধীরা অবশ্য প্রশ্ন তুলছে, বকেয়া টাকা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আনবে রাজ্য সরকার? আর তা ছাড়া, দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের আড়াল করতেই কি রাজ্যের এমন উদ্যোগ? তৃণমূল যদিও পাল্টা দাবি করছে, খরচের কৈফিয়ত তারা বিরোধীদের দেবে না। জবাব দেওয়া হবে মানুষের কাছে।
আপাতত বকেয়া টাকা রাজ্য সরকারই মিটিয়ে দেবে বলে ঘোষণা করে দেওয়ার পরেও রেড রোডে তৃণমূলের ধর্না অবশ্য চলছে। সপ্তাহান্তে সেই ধর্নায় দলের সাংসদ ও বিধায়কদের হাজির থাকার কথা দলীয় নেতৃত্বের তরফে ঘোষণা করা হলেও রবিবারও সেখানে দেখা যায়নি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দিল্লির কাছে পাওনা আদায়ের দাবিতে অভিষেক রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন। তার পরে দলনেত্রী মমতার নির্দেশে সেই ধর্না তিনি প্রত্যাহার করেছিলেন। এ বার স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী ধর্নার কর্মসূচি নেওয়ায় সেখানে অভিষেককে এখনও দেখা না যাওয়ায় শুরু হয়েছে জল্পনা।
বকেয়া টাকা রাজ্যেরই দিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিজেপির আর্থিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।’’ পাশাপাশি, ডেরেক দাবি করেন, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, উত্তরাখণ্ডের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি হাজার হাজার কোটি টাকার ইউসি জমা দেয়নি। ডেরেক, তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারদের অভিযোগ, বাংলায় মমতার সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে আর্থিক সন্ত্রাস চালানোর চেষ্টা করছে বিজেপি।
কিন্তু বকেয়া টাকা রাজ্য মেটাতে গেলে তার উৎস কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কাঁথিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, ‘‘অর্থ দফতরের বাজেট শাখাকে ৭ তারিখের আগে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। চোর ঠিকাদারদের সেই টাকা দিয়ে লোকসভা ভোটের বৈতরণি পার করতে চাইছে তৃণমূল!”
সিএজি-র অভিযোগ প্রসঙ্গেও ফের সংঘাত বেধেছে। খোদ মমতা দাবি করেছিলেন, ২০০৩-এর হিসাব চেয়েছে সিএজি। কিন্তু রাজ্যে তখন তৃণমূল ক্ষমতায় ছিল না। একই সুরে বিষয়টির দায় বামেদের উপরে চাপিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষও। তিনি বলেন, “রিপোর্টে ২০০২-০৩ থেকে ২০২০-২১ সময়-পর্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত বাংলায় ক্ষমতায় ছিল বামেরা। তৃণমূল সেই সময়ের দায় নিতে পারে না।” পাশাপাশি, তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাবতীয় শংসাপত্র জমা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘গরিব মানুষ তাঁদের হকের টাকা পান, এটা তো আমাদেরও দাবি। কিন্তু রাজ্য সরকারই যদি টাকা দেবে, তা হলে বঞ্চিত মানুষদের এত দিন অপেক্ষায় রাখল কেন? কেন্দ্রের কাছে টাকা আদায়েরই বা কী হল? তা ছাড়া, দুর্নীতির যে অভিযোগে ১০০ দিন বা আবাস প্রকল্পের টাকা আটকে দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাপারে অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টাও কি এই পথে করতে চাইছে রাজ্য?’’ সিএজি-প্রশ্নেও তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলকে কেউ ওই সময়ের দায় নিতে বলেনি। কিন্তু ওই সময়ে ১০০ দিনের কাজের আইন হয়নি। আর বাম জমানায় ওই সময়ে রাজ্যে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) মাথায় ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়েরা। হারিয়ে না ফেললে সেই রিপোর্ট বার করে তৃণমূল নেতৃত্ব দেখতে পারেন।’’
রতুয়ায় দলের কর্মী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এ দিন বলেন, “কাজ করলে ইউসি দিতে হয়। কেন্দ্র বলছে ইউসি দিন। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন দেব না। এই টাকা নরেন্দ্র মোদীর নয়, মমতারও পকেটের টাকা নয়। হিসাব দিতে হবে। নয়তো কান ধরে হিসাব নেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করব!” আর গোটা বিষয়টির মধ্যে দুর্নীতি দেখছেন শুভেন্দু। তাঁর অভিযোগ, “তৃণমূলের চোরেরা সব পঞ্চায়েতে ৮০% ভুয়ো বিল করে রেখেছে। হাই কোর্টের নির্দেশে চার সদস্যের দল তদন্ত করলেই ভুয়ো বিল ধরা পড়বে। এটা শিক্ষা-কয়লা-গরু-রেশনের মতো বড়সড় দুর্নীতি, তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়লেই তা স্পষ্ট হবে।”
পাল্টা সিপিএম ও বিজেপিকে এক পঙ্ক্তিতে বসিয়ে ফালাকাটায় রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের তোপ, “রাজ্যের মানুষ ১০০ দিনের টাকা থেকে বঞ্চিত। বিজেপি ও সিপিএম এই নিয়ে শুধু রাজনীতি করছে। ওরা চায় না গরিব জনগণ হকের টাক পাক।” সেই সঙ্গেই টাকার উৎস নিয়ে ওঠা যাবতীয় প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের কুণালের মন্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার কোন খাতের টাকা কোন খাতে খরচ করবে, সেই কৈফিয়ত বিরোধীদের দেব না! যে বিরোধীরা বাংলার মানুষের টাকা আটকে রেখেছে, তাদের কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার নেই! তৃণমূল মানুষের কাছে জবাব দেবে।’’