Abhishek Banerjee’s Virtual Meeting

তৃণমূলের সংগঠনে অভিষেকের ‘প্রত্যাবর্তন’! মাঠ বড় করলেন সাধারণ সম্পাদক, জায়গা করে দিলেন সর্বময় নেত্রী মমতাই

শনিবার অভিষেক-আহূত সভার আলোচ্য ছিল ভোটার তালিকা সংশোধন। কিন্তু সেই বৈঠকেই সার্বিক ভাবে সাংগঠনিক বার্তাও দিয়েছেন তিনি। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন সূচকে ‘দূরত্ব’ যেমন স্পষ্ট হয়েছিল, তেমন ‘প্রত্যাবর্তন’ও স্পষ্ট হয়ে গেল।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ২২:০১
Share:

(বাঁ দিকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

লোকসভা ভোটের পর থেকেই তৃণমূলের অন্দরে আলোচনার বিষয় ছিল সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ‘দূরত্ব’। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোরের সভার পর শাসকদলে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, ‘দূরত্ব’ বাড়ল না কমল? শনিবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভার্চুয়াল সভার পর সেই কৌতূহলের নিরসন হয়েছে। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই বলছেন, সংগঠনে ‘প্রত্যাবর্তন’ হল অভিষেকের। ডায়মন্ড হারবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে মাঠ বড় করলেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে সেই জায়গা করে দিলেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

শনিবার অভিষেক-আহূত সভার আলোচ্য ছিল ভোটার তালিকা সংশোধন। কিন্তু সেই বৈঠকেই সার্বিক ভাবে সাংগঠনিক বার্তাও দিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন, পাঁচ দিনের মধ্যে ভোটার তালিকা সংক্রান্ত জেলা কমিটি গঠন হবে, মার্চের তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহেই সম্পন্ন হয়ে যাবে ব্লকের কমিটি গঠন। পাশাপাশিই অভিষেক জানিয়ে দিয়েছেন, কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে একাধিক সাংগঠনিক জেলা ও ব্লকগুলির সভাপতি বদল করা হবে।

লোকসভা ভোটের অব্যবহিত পরেই সংগঠন থেকে ‘সাময়িক বিরতি’ নিয়ে চোখের চিকিৎসা করাতে বিদেশে গিয়েছিলেন অভিষেক। ২১ জুলাইয়ের বার্ষিক শহিদ সমাবেশে তিনি যোগ দেবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সভার আগের দিন কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। যোগ দিয়েছিলেন সভায়। সেই মঞ্চ থেকেই অভিষেক ঘোষণা করেছিলেন, লোকসভা ভোটে যে যে এলাকায় দলের ফল খারাপ হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ব বদল করা হবে। কিন্তু আট মাসেও তা কার্যকর হয়নি। অগস্ট মাসে আরজি করের ঘটনার পরে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখন কয়েকটি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্ট ছাড়া অভিষেক নীরবই ছিলেন। তার পরের দু’মাস উৎসবে কেটে গিয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি তখন কমই ছিল। কিন্তু ২০২৫ সাল পড়তেই দেখা যায় অভিষেক নিজেকে আবার ডায়মন্ড হারবারে ‘সীমাবদ্ধ’ করে ফেলেছেন। গত আড়াই মাস তাঁর যাবতীয় ব্যস্ততা ছিল নিজের লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচি ঘিরে।

Advertisement

অভিষেক যখন নিজেকে ডায়মন্ড হারবারে ‘আবদ্ধ’ রেখেছেন, তখন নেত্রী মমতা বারংবার বার্তা দিয়েছেন, দলে ‘শেষকথা’ বলবেন তিনিই। সরকার, সংসদীয় দল, সংগঠন— সব ক্ষেত্রেই। একটি বৈঠকে মমতা বলেন, তিনিই আরও ১০ বছর দল চালাবেন। এর মধ্যে কয়েক মাস আগে তৃণমূলে মুখপাত্রদের নতুন তালিকা করা হয়েছিল। যে তালিকা থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল দলে ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত একাধিক নেতাকে। সব মিলিয়ে ‘দূরত্ব’ নিয়ে জল্পনা আরও দানা বাঁধছিল। সেই জল্পনা কখনও উস্কে দিয়েছে এক বছর আগেও অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ বৃত্তে’ থাকা নেতার ‘উল্টো সুর’, কখনও গাঢ় করেছে অভিষেকের দফতর থেকে পাঠানো ক্যালেন্ডারে ছবি-বিতর্ক। যেখানে অভিষেকের তুলনায় মমতার ছবি আকারে কিছুটা বড় ছিল। নজরে আসার পরেই তা বাতিল করেন রাজ্য নেতৃত্ব। নতুন করে ক্যালেন্ডারের নকশা পাঠাতে হয় ক্যামাক স্ট্রিটকে। পুজোর পর থেকে একাধিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছিল তৃণমূলের ‘ভরকেন্দ্র’ বদলাচ্ছে।

সেই সূত্রেই শনিবারের সভায় অভিষেকের ভূমিকাকে ‘প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে দলের অন্দরে। তবে পাশাপাশিই তারা এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সংগঠনে ‘সেনাপতি’র এই প্রত্যাবর্তনও হয়েছে দলনেত্রীর অনুমোদন ক্রমেই।

মমতা নিজে কবে এত বড় বহরে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন, তৃণমূলের অনেকেই তা মনে করতে পারছেন না। অভিষেক কেন মমতার গড়ে দেওয়া ভোটার তালিকা সংক্রান্ত ৩৫ জনের কমিটির বৈঠকে যাননি, তা নিয়ে শাসকদলে প্রশ্ন ছিল। তৃণমূল ভবনের সেই বৈঠকে না গিয়ে অভিষেকের পৃথক বৈঠক ডাকার অর্থ কী, তা নিয়েও কৌতূহল ছিল। কিন্তু যে ভাবে শনিবার ৪,৫০০ নেতাকে নিয়ে অভিষেক ভার্চুয়াল সভা ডেকেছিলেন, তাতে যে মমতার অনুমোদন রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সভার পর আরও স্পষ্ট হল যে, অভিষেক রাজ্যের সংগঠনে ফিরে এলেন। ডায়মন্ড হারবারের ‘গণ্ডি’ ছাড়িয়ে সারা বাংলার সংগঠনে প্রত্যাবর্তন হল তাঁর।

অভিষেকের সাংগঠনিক কাজের নির্দিষ্ট ঘরানা রয়েছে। তা মমতার থেকে পৃথক। অভিষেক পেশাদার সংস্থাকে নিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু সেই আইপ্যাক সম্পর্কে কয়েক মাস আগে মমতা অভ্যন্তরীণ বৈঠকে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে ‘দূরত্ব’ যেমন স্পষ্ট হয়েছিল, তেমনই আবার নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকে মমতার ‘আমার আইপ্যাক’ সম্বোধনে ‘দূরত্ব’ ঘোচার সঙ্কেত ছিল। ঘটনাচক্রে, তার আগে মমতার সঙ্গে আইপ্যাক কর্ণধার প্রতীক জৈন নবান্নে গিয়ে বার দুয়েক বৈঠকও করেছিলেন।

তৃণমূলের এখন মুখ্য ‘কাজ’ ভোটার তালিকা সংশোধন। সেই কাজে সংগঠনের পাশাপাশিই যে পেশাদার সংস্থার সমীক্ষাও প্রয়োজন, তা মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নেতাজি ইন্ডোরের সভায়। যে নেতারা আইপ্যাক নিয়ে প্রকাশ্যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশেও ‘বার্তা’ দিয়েছিলেন দলের সর্বোচ্চ নেত্রী। শনিবার অভিষেক তথ্য এবং পরিসংখ্যান তুলে ধরে যে ‘সাফল্য এবং দুর্বলতা’র কথা বলেছেন, যে ভাবে ভিডিয়ো দেখিয়ে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজের প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন, তাতে দলের অন্দরে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, সাংগঠনিক কাজ দেখার বিষয়ে মমতা তাঁকে অনুমোদন দিয়েছেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতরে গিয়ে ভার্চুয়াল সভায় তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। দলের অন্দরে একটা সময় বক্সী-অভিষেক সম্পর্ক নিয়েও অনেক জল্পনা থেকেছে। অনেকে আরও ‘তাৎপর্য’ দেখছেন ভার্চুয়াল সভায় অভিষেকের আসনের পটভূমিকায় কারও ছবি ছিল না। ছিল তৃণমূলের পতাকা। অর্থাৎ, মমতা যা বলেন, ‘‘পতাকাই সব।’’

গত লোকসভা ভোটের দু’মাস আগে ডায়মন্ড হারবারের ‘গণ্ডি’ ছেড়ে বেরিয়ে সংগঠনে ফিরেছিলেন অভিষেক। বিধানসভা ভোটের এক বছর আগেই ময়দানে নামলেন তিনি। যদিও অভিষেক নিজে মনে করেন, এক বছর নয়, হাতে সময় বড়জোর পাঁচ মাস। কারণ, বর্ষা-উৎসব-পরীক্ষা ইত্যাদিতে বাকি সময়টা চলে যাবে। এখন দেখার, সংগঠনে মাঠ বড় করার যে অনুমোদন অভিষেককে দিয়েছেন মমতা, সেই মাঠে অভিষেক ‘ওভারল্যাপে’ উঠে গোল করে আসতে পারেন কি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement