দিল্লির পথে বিমানবন্দরে অভিষেক। —নিজস্ব চিত্র।
একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনায় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে দিল্লিতে দু’দিনের কর্মসূচি নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এ বার বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় ঘরের দেওয়াল চাপা পড়ে চার জনের মৃত্যুর ঘটনাকে সেই অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে নতুন ‘হাতিয়ার’ করল তারা। বাঁকুড়ায় মৃতদের পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে রবিবার দিল্লি গেলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতাদের হাতে ‘রক্ত লেগে আছে’ বলে অভিযোগ করার পাশাপাশিই, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহকে গ্রেফতার করার দাবি তুলেছেন তিনি। মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ওই পরিবারের স্বজনদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে শনিবার সকালে দেওয়াল ভেঙে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় বিষ্ণুপুরের বড়ামারা গ্রামের অঙ্কুশ সর্দার (৩), নিশা সর্দার (৪) ও রোহন সর্দারের (৫)। মৃতের পরিবারের দাবি ছিল, আবাসের তালিকায় নাম থাকলেও টাকা না মেলায় পাকা বাড়ি গড়া যায়নি। বাঁকুড়ার ছাতনা ও পুরুলিয়ার কেন্দায় এ দিন আবার দু’টি পৃথক ঘটনায় ঘরের দেওয়াল চাপা পড়ে যথাক্রমে পূরবী হাঁসদা (৬৮) ও আরও একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দু’ক্ষেত্রে পরিবারের নাম আবাস যোজনার তালিকায় রয়েছে, জানাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।
ওই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনেই দিল্লি যাওয়ার পথে এ দিন কলকাতা বিমানবন্দরে অভিষেক বলেন, ‘‘তিনটি ফুলের মতো শিশু মারা গিয়েছে। মাটির কাঁচা দেওয়াল ভেঙে মারা গিয়েছে তারা। এর দায় কার? বিচার ব্যবস্থার কাছে আবেদন করেছি। এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত হওয়া উচিত।’’ মৃত শিশুদের পরিজনেদের দেখিয়ে অভিষেকের আরও বক্তব্য, ‘‘গণতন্ত্রে মানুষ শেষ কথা বলবে। শুনলাম, পূরবী হাঁসদা নামে এক বৃদ্ধাও মাটির দেওয়াল ভেঙে মারা গিয়েছেন। বীরভূমের লাভপুরে একই ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার দায় প্রধানমন্ত্রী, গিরিরাজ সিংহ ও বাংলার বিজেপি নেতাদের। তাঁদের হাতে রক্ত লেগে আছে!’’ তাঁর দাবি, ‘‘গিরিরাজ সিংহকে গ্রেফতার করা উচিত! মোট ৩৩ লক্ষ লোকের তালিকা পাঠানো হয়েছিল। ১১ লক্ষ মানুষের আধার ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সংযোগ হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকার তালিকাও পাঠিয়ে দিয়েছে, তা-ও আবাসের টাকা বন্ধ কেন?’’
অভিষেক এ দিন মন্তব্য করেছেন, ‘‘পরিবারের এত শোকের দিনেও এঁরা (মৃতদের পরিজনেরা) এক কাপড়ে দিল্লি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কুর্নিশ জানাই এই ভাইদের! বেদনাদায়ক ঘটনার পরে আমার সঙ্গে দেখা করে দিল্লি যাব বলে জানিয়েছেন। এই ভাইদের জন্য প্রতিবাদে আমরা দিল্লিতে সরব হব।’’ তবে দিল্লি রওনা হওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের কাছে মৃত রোহনের বাবা জয়দেব সর্দার দাবি করেছেন, ‘‘আমাকে দিল্লি নিয়ে যেতে চাইছে। তবে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমার কিছু চাই না।” তিন মৃতের পরিবারকে এ দিন দলের তরফে তিন লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব।
এই সূত্রেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘জোর করে’ লোকজনকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তৃণমূলের অভিযোগ প্রসঙ্গে শুভেন্দুর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘আবাস যোজনায় ৫০ লক্ষ বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে মোদী সরকার। চুরি বন্ধ করতেই কেন্দ্রীয় সরকার এ রাজ্যে বেআইনি ১১ লক্ষ আবাসের টাকা আটকে রেখেছে।’’ তাঁর আরও দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার টাকা আটকায়নি। শুধু হিসেব চেয়েছে। অভিষেকের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওঁর সব কথার উত্তর দিতে হবে নাকি? তৃণমূল কি বিরোধী দল? তিন তলা পাকা বাড়ির ভুয়ো তালিকা বানিয়েছিল!’’
শিশুদের মৃত্যু নিয়ে শাসক দল রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ তুলে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের প্রশ্ন, ‘‘এখন না হয় আবাস যোজনায় বরাদ্দ বন্ধ। কিন্তু এত দিন তো দেওয়া হচ্ছিল। সেই ঘরগুলো গরিব মানুষ পায়নি কেন?’’ বিজেপির বিধায়কেরা আজ, সোমবার কলকাতায় বিক্ষোভ দেখাবেন বলে জানান তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘আমরা চার-পাঁচ জন সাংসদ দিল্লি যাচ্ছি। সেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজের সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক বৈঠক করে চোরকে সামনে আনব!” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘দেওয়াল চাপা পড়ে শিশুদের মৃত্যু ভয়বাহ। কিন্তু তাই নিয়ে রাজনীতির পাশা খেলা আরও ভয়ঙ্কর! না। রাজ্যে তৃণমূলের সরকার আছে ১২ বছর। আবাস যোজনার টাকা এক-দেড় বছর পাওয়া যাচ্ছে না। আগের ১০ বছর কী হচ্ছিল? মনে হচ্ছে কেউ কি এই মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন? যাতে ঘটনা ঘটলেই পরিবারকে দিল্লি টেনে নিয়ে গিয়ে রাজনীতি করা যায়? মৃত্যুকে ব্যবহার করে এই রাজনীতি নোংরামি! তৃণমূল এবং বিজেপি নোংরামি করছে।’’
শিলিগুড়িতে এসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিও এ দিন বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় প্রকল্পে তৃণমূল যে ‘কাটমানি’ খাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ বার সেই টাকা চাইতে দিল্লিতে যাচ্ছে। যখন মহিলারা ধর্ষিত হয়, শিলিগুড়িতে একটা বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, তখন দিল্লি গিয়ে কেন মিছিল করলেন না? চা-শ্রমিকেরা পাট্টা, ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না, জমি-বাড়ি নেই, তখন কেন দিল্লিতে যাচ্ছেন না?’’