আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আব্বাস সিদ্দিকির দল ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’ (আইএসএফ) রাজ্যে ৩৬-৪০টি আসনে ‘নির্ণায়ক শক্তি’ হিসাবে প্রভাব ফেলতে পারে। ২৯৪ আসন বিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই আসনসংখ্যা তুলনায় কম। কিন্তু তুল্যমূল্য এই ভোটে ফলাফলের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাও কার্যকরী হতে পারে বলে মনে করছেন রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা। কারণ, এবারের ভোটযুদ্ধে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে একেকটি আসনও ‘গুরুত্বপূর্ণ’। সেকথা সম্যক বুঝেই বাম-কংগ্রেস জোট আব্বাসের দলকে তাদের সঙ্গে আসতে আহ্বান করেছে। বাম এবং কংগ্রেসের সঙ্গে আব্বাসের দলের আলাদা আলাদা আলোচনা হয়েছে। বস্তুত, আব্বাসের দল যে এই ভোটে ‘নির্ণায়ক শক্তি’ হয়ে উঠতে পারে এবং খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে তা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। তাঁর চিঠিতে মান্নান ‘গেমচেঞ্জার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের কাছে আব্বাস খানিক উদ্বেগের বলেই দলীয় সূত্রের খবর। নীলবাড়ি দখলে রাখার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু ভোটই তৃণমূলের সবচেয়ে বড় পুঁজি। তথ্য বলছে, তাছাড়া দক্ষিণবঙ্গের যে সমস্ত এলাকায় আব্বাস তাঁর প্রভাব সবচেয়ে বাড়িয়েছেন, মূলত সেই সমস্ত বিধানসভা এলাকায় জিতেই ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছাড়াও হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে দলের প্রভাব বাড়াতে পেরেছেন ফুরফুরা শরিফের এই তরুণ পিরজাদা। তাঁর অনুগামীদের দাবি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সুন্দরবন এলাকার সবচেয়ে বেশি প্রভাব তৈরি করেছেন তাঁরা। সঙ্গে হাওড়ার উলুবেড়িয়া লোকসভা এলাকা তো বটেই, হুগলির জাঙ্গিপাড়া, চণ্ডীতলা, খানাকুল, পুড়শুড়া, আরামবাগের মতো বিধানসভা এলাকাতেও আব্বাসের প্রভাব চোখে পড়ার মতো বলেই দাবি করেছেন তাঁরা। এছাড়াও নদিয়া জেলার চাপড়া, কালীগঞ্জ, পলাশিপাড়া, নাকাশিপাড়া, তেহট্ট এবং করিমপুর বিধানসভার ভোটের ফলাফলে তাঁরাই ‘নির্ণায়ক শক্তি’ হতে পারেন বলে দাবি করছেন আব্বাস অনুগামীরা। যে দাবির মধ্যে খুব একটা অতিরঞ্জন দেখছেন না তৃণমূল বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকরা।
বীরভুমের হাসন, মুরারই, লাভপুর এবং নানুরের মতো এলাকাতেও এই নতুন রাজনৈতিক দলের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে মালদহের ৪-৬টি আসনেও ‘ভাইজান ফ্যাক্টর’ কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন তাঁর অনুগামীরা। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ৩৬ থেকে ৪০টি আসনে আব্বাস ‘নির্ণায়ক শক্তি’ হয়ে উঠতে পারেন বলে অভিমত জোটের কুশীলবদের। শেষ জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের পরিমাণ ২৬ থেকে ৪০ শতাংশ। শাসক তৃণমূল চাইছে, ওই ৩০ শতাংশ ভোটের পুরোটাই তাদের ঝুলিতে আসুক। তা হলে সরকার গঠনের লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে তারা। কিন্তু বাদ সাধতে পারে আব্বাসের দল। সে কারণেই আরও বেশি করে তাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে চেয়েছিল সিপিএম এবং কংগ্রেস। সেই আলোচনাও চূড়ান্ত।
তবে দল ঘোষণার বহু আগে থেকেই নিজের রাজনৈতিক জমি তৈরি শুরু করে দিয়েছিলেন আব্বাস। দক্ষিণবঙ্গের গ্রামীণ বিধানসভা এলাকায় গিয়ে একাধিক জনসভা করে ২০২১ সালের ভোটে ল়ড়াইয়ের কথাও ঘোষণা করেছিলেন। সেই সমস্ত জনসভাগুলিতে সাড়া পেয়েই দ্রুত নির্বাচন কমিশনে নতুন দলের নথিভুক্তির আবেদন করেন আব্বাস। দল ঘোষণার আগেই ফুরফুরা শরিফে এসে আব্বাসের সঙ্গে জোটের কথা বলে গিয়েছিলেন মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। প্রথম দিকে মূলত সংখ্যালঘু-নির্ভর রাজনৈতিক দল গড়ার ভাবনা হলেও পরে সেই কৌশলে বদল আনেনে আব্বাস। ঠিক হয়, শুধু সংখ্যালঘু অধিকারই নয়, তফসিলি জাতি-উপজাতি, মতুয়া সমাজ-সহ দলিতদের হয়েও সোচ্চার হওয়া হবে। সেই রণনীতিতেই দলের সভাপতি করা হয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধিকে। নাম শ্রীমন সোরেন। দল প্রতিষ্ঠার দিনই আব্বাস জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র মুসলমান নয়। দেশের সমস্ত পিছিয়ে-পড়া জনজাতির হয়ে কাজ করবে তাঁদের রাজনৈতিক দল। আইএসএফের এক নেতা দাবি করেছেন, সম্প্রতি হিন্দু-অধ্যুষিত বিধানসভা অশোকনগরে জনসভা করতে গিয়েও ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন ‘ভাইজান’। ফলে আইএসএফ কেবল মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়, একথা বোধহয় ঠিক নয়। ঘটনাচক্রে, আব্বাসের প্রায় সমস্ত জনসভায় উপচে-পড়া ভিড় দেখেই তাঁর দল আইএসএফ-কেও নিজেদের জোটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাম-কংগ্রেস। তখনই তাঁকে ‘গেমচেঞ্জার’ বলে অভিহিত করে সনিয়াকে চিঠি লেখেন বিরোধী দলনেতা মান্নান। তার পর থেকেই শুরু আব্বাসের সঙ্গে জোটের বল গড়ানো।