Amita Shabar

পিছোতে দেবে না বছর চোদ্দোর অমিতা শবর

সম্প্রতি ওই শবরটোলায় শীতবস্ত্র দিতে গিয়ে ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরা নবম শ্রেণির পড়ুয়া অমিতার ‘পাঠশালা’ দেখে তাজ্জব হয়ে যান।

Advertisement

রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:১৮
Share:

পাঠশালায় অমিতা শবর। বান্দোয়ানের কেতকি শবরটোলায়। নিজস্ব চিত্র

রাত প্রায় ৮টা। শবরটোলায় পথবাতির আলোয় এলাকার কচিকাঁচারা দুলে দুলে পড়ে যাচ্ছে— ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’। কাঠের পাটাতনে খড়িমাটি বা চক দিয়ে ‘অ-আ’ লিখে দিচ্ছে তাদের ‘অমিতাদি’। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের কেতকি শবরটোলার বছর চোদ্দোর অমিতা শবর। করোনা-পর্বে টানা স্কুল বন্ধের সময় এলাকার কচিকাঁচারা যাতে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, সে জন্য প্রতি সন্ধ্যায় বিনামূল্যে তাদের পড়িয়ে যাচ্ছে সে।

Advertisement

সম্প্রতি ওই শবরটোলায় শীতবস্ত্র দিতে গিয়ে ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরা নবম শ্রেণির পড়ুয়া অমিতার ‘পাঠশালা’ দেখে তাজ্জব হয়ে যান। বিডিও (বান্দোয়ান) কাসিফ সাবির বলেন, ‘‘ওই পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্ল্যাকবোর্ড, চক, খাতা, পেন দেওয়া হয়েছে। অমিতার পাশে আমরা রয়েছি।’’

মা মারা যাওয়ার পরে, ভাই মলিন্দ্রকে নিয়ে ঠাকুমা মঙ্গলিদেবীর সঙ্গে থাকে অমিতা। বাবা বনমালী শবরের আলাদা সংসার। তবে তিনি মেয়েকে পড়ানোর জন্য বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বান্দোয়ান গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি করান। সেখানকার হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে অমিতা। তবে সে এই পাঠশালা খুলেছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়।

Advertisement

কেন? অমিতার কথায়, ‘‘স্কুলে ছুটি থাকলে বাড়ি এসে দেখতাম, টোলার ছোটরা কেউ পড়াশোনা করে না। তাতে আমারও পড়ার ইচ্ছে হত না। পরে বুঝেছি, ওদেরও পড়াশোনা করা জরুরি। তাই ছুটি পেলেই বাড়িতে এসে সন্ধ্যার পরে, পড়ার ছেলেমেয়েদের ডেকে এনে পড়ানো শুরু করি। আমি চাই, নিজে যতটা শিখেছি, ততটাই ওদেরও শেখাব। কাউকে পিছিয়ে থাকতে দেব না।’’

করোনার জন্য মার্চের শেষ থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় এখন ‘অমিতাদির পাঠশালা’ রোজ সন্ধ্যায় খোলা। সে জন্য সকালেই একেবারে রাতের খাবারও তৈরি করে নেয় অমিতা। বাকি সময়ে নিজের পড়া ও বাড়ির ছাগল চরানোর কাজ করে সে। সন্ধ্যা হলেই বন দফতরের বসানো সৌরবাতির নীচে পাঠশালায় টেনে নিয়ে যায় পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া ভাইকে। সেখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫৫ জন তার কাছে পড়ে। বান্দোয়ান গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মুনমুন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অমিতা নিজে টিউশন নেয় না। কিন্তু স্কুলে ভাল ফল করে। ও যে এই সময়ে পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, তা ভাবতে গর্ব হচ্ছে।’’

শবরটোলার ৩০টি পরিবার দিনমজুরি করে সংসার চালায়। অনেক পরিবারেই পুরুষেরা মদের নেশায় অভ্যস্ত। ডেকে বুঝিয়ে তাঁদের অনেককে নেশাও ছাড়িয়েছে অমিতা। পড়শি অনিল শবরের দুই ছেলে, এক মেয়ে অমিতার কাছে পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হলেও বাড়িতে পড়ত না। এখন ওরা সন্ধ্যা হলেই অমিতার কাছে পড়তে ছোটে। ওর কথায় আমিও মদ প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।’’ অমিতার কাছে নাম লেখা শিখেছেন শবর তরুণী শিলাবতী শবর, মুসরি শবরেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘বাংলায় নাম লেখা শিখেছি। অমিতা ইংরেজি হরফ অভ্যাস করাচ্ছে।’’

খেড়িয়া শবরদের মধ্যে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্নাতক হয়েছেন পাশের বরাবাজার ব্লকের রমনিতা শবর। তিনি বলেন, ‘‘শুধু প্রশংসা নয়, অমিতার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা রয়েছে। সময় পেলে আমিও এলাকার ছোটদের জন্য পাঠশালা খুলতে চাই।’’ অমিতা বলেছে, ‘‘বড় হয়ে কী করব জানি না। তবে চিরকাল শবরদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement