Teacher

কেউ সূর্য, কেউ পৃথিবী, খেলাচ্ছলে ক্লাসে ভূগোল

কখনও ছয় ছাত্রের বৃত্ত পৃথিবী সেজে ঘুরছে। দূরে দাঁড়িয়ে এক ছাত্র সূর্য। এই ঘুরতে থাকা পৃথিবীর অবস্থানেই বদলাচ্ছে দিন, রাত্রি, সময়। কখনও ভূপৃষ্ঠ গড়ে তুলেছে ৭-৮ জন ছাত্র মিলে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৩১
Share:

মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের জোতকমল স্কুলে চলছে সেই ভূগোল ক্লাস। —নিজস্ব চিত্র।

ক্লাসে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে এক ছাত্র। ছাতার উপরে মোবাইলের আলো ফেলছেন শিক্ষক। ছাতা এখানে ওজ়োন স্তর, ছাত্র পৃথিবী, মোবাইলের আলো সূর্য। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি আর পৃথিবীর মাঝে থাকা ওজ়োন স্তররূপী ছাতাকে সরিয়ে দিতেই মোবাইল তথা
সূর্যের রশ্মি সরাসরি পৃথিবীর উপর পড়ে নষ্ট করছে ভারসাম্য, ক্ষতি হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের, বাড়ছে তাপমাত্রা। হাঁ করে এই দৃশ্য নিঃশব্দে গিলছে গোটা ক্লাস।

Advertisement

খেলা না পড়া? এই ক্লাসে ঢুকলে বোঝা দায়! ব্ল্যাক বোর্ডের গতানুগতিক পঠনপাঠন থেকে বেরিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা ভূমিকায় সাজিয়ে পড়ার অঙ্গ করে তুলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের জোতকমল হাই স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক সুবীর দাস। ক্লাসে কেউ কোনও দিন সূর্য, কেউ চাঁদ, কেউ পৃথিবী। কেউ আর এক দিন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র। ভূগোলকে গোলকধাঁধা থেকে বার করে এনে আনন্দের পাঠদানের মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে প্রিয় বিষয় করে তুলতে পেরেছেন সুবীর, গত দশ বছরের অক্লান্ত চেষ্টায়।

সুবীর বলেন, ‘‘বিষয় বস্তুর সঙ্গে চাই ছাত্রের সক্রিয় যোগদান। চোখে দেখা কোনও কিছু ছাত্রেরা কখনও ভোলে না। সেটা তুলে ধরতে হবে তাদের মাধ্যমেই। যে ছাত্র বিষয়ভিত্তিক যে নামে চিহ্নিত থাকবে, তাকে সেই নামেই ডাকবে ক্লাসের বাকি ছাত্ররা।’’

Advertisement

চন্দ্রযান অভিযানের জটিলতা কাটাতে ছাত্রদের ডেকে নিয়ে সুবীর দাঁড় করান ক্লাসের মধ্যে। আমেরিকায় চন্দ্রাভিযান হয়েছিল প্রথম, খরচ হয়েছিল ১৬০০ কোটি টাকা। ভারতের চন্দ্রাভিযান কী ভাবে সম্ভব হয়েছে এত কম টাকায়? অষ্টম শ্রেণির ছাত্রদের জলের মতো তা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন সুবীর। আর সে সব করতে গিয়ে ছাত্রদেরই চাঁদ, পৃথিবী, চন্দ্রযান সাজিয়ে তা অভিনয় করিয়ে দেখান সুবীর।

লালগোলার বাসিন্দা সুবীর স্কুলের ছাত্রদের এতটাই প্রিয় শিক্ষক যে, অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ দুই ছাত্রীর আবদার, ‘‘নবম শ্রেণিতে ভূগোলের ক্লাসটা স্যর আপনিই নেবেন।’’ সুবীরের শিক্ষকতার জীবন শুরু লালগোলারই সেখালিপুর হাই স্কুলের পার্শ্ব শিক্ষক হিসেবে। পরে কান্দির বড়ঞার কুণ্ডল হাই স্কুলে ছিলেন বছর চারেক। সেখান থেকেই এসেছেন জোতকমল হাই স্কুলে।

সুবীরের কথায়, ‘‘আমি নিজে পড়া ঠিক মতো বুঝতে পারতাম না ক্লাসে। আমাকে সাহায্য করেছিলেন আমার দাদা। তিনি এখনও গৃহশিক্ষকতা করেন। তাঁর কাছেই শিখেছি, পঠনপাঠনকে কী ভাবে আনন্দদায়ক করে তুলতে হয়। শিখেছি কী ভাবে বই ছাড়া, লাঠি ছাড়া একটি ক্লাসকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে হয় খেলাচ্ছলে পড়িয়ে।’’

কখনও ছয় ছাত্রের বৃত্ত পৃথিবী সেজে ঘুরছে। দূরে দাঁড়িয়ে এক ছাত্র সূর্য। এই ঘুরতে থাকা পৃথিবীর অবস্থানেই বদলাচ্ছে দিন, রাত্রি, সময়। কখনও ভূপৃষ্ঠ গড়ে তুলেছে ৭-৮ জন ছাত্র মিলে। ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র গিয়ে ধাক্কা মারছে ভূপৃষ্ঠের যে অংশে, সেখানে ক্ষতি হচ্ছে, পিছনে থাকা ছাত্রদের ক্ষয় ক্ষতি কম হচ্ছে। এ ভাবেই পড়ায় যোগদান করিয়ে মনোযোগ বাড়াচ্ছেন ছাত্রদের।

জোতকমল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিবশঙ্কর সাহা বলছেন, “প্রত্যেক শিক্ষকের পাড়ানোর নিজস্ব পদ্ধতি থাকে। স্কুলে ভূগোলের ৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। সুবীরবাবুর পড়ানোর পদ্ধতি অভিনয়ভিত্তিক। ছাত্ররা তা উপভোগ করে।’’

নবম শ্রেণির ছাত্র ইনজামাম শেখ বলছে, ‘‘মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন স্যর ভূগোলকে। তাই এ বারে ৯৫ পেয়েছি ভূগোলে।’’ দশম শ্রেণির আসমা খাতুনের কথায়, ‘‘মনে পড়ে না স্যরের ক্লাসে কখনও গরহাজির থেকেছে কেউ। এত দিন স্কুলে পড়ছি। ক্লাসে থাকার মধ্যেও যে এত আনন্দ আগে বুঝিনি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement