প্রবাসে বাংলার বশে।—প্রতীকী চিত্র // সৌজন্যে শাটারস্টক।
একুশে ফেব্রুয়ারির কথা প্রথম শুনেছিলাম জয়ন্তবাবুর কাছে। আমাদের হাইস্কুলের ইংরেজির স্যর। জয়ন্তবাবু কম্যুনিস্ট ছিলেন। বাংলা সাহিত্যটা গুলে খেয়েছিলেন, হয়তো সে জন্যই ইংরেজিটা পড়াতেন মনের চেতনা মিশিয়ে। আমরা একেবারে হাঁ করে শুনতাম। সে দিন উনি মুলক রাজ আনন্দের ‘আওয়ার হেরিটেজ’ পড়াচ্ছিলেন। পড়াতে পড়াতে ওই পংক্তিটা এল, ‘একটা জাতি না খেতে পেলেও উঠে দাঁড়ায়, যদি তার বুকের গভীরে সংস্কৃতিটা থাকে!’ বার দুই ওই বাক্যটা পাঠ করে, তারপরে বইটা বন্ধ করে দিয়ে জয়ন্তবাবু বললেন, ‘‘আমাদের সংস্কৃতিটা কী, জানিস? আমাদের ভাষা। আমাদের মায়ের ভাষা, বাংলাভাষা!’’
জয়ন্তবাবু একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢুকে পড়লেন। এটা কি বাংলার ক্লাস, নাকি ইংরেজির, নাকি কোনও মহত্তর ইতিহাসের! ক্লাসরুমের খোলা জানলা দিয়ে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উজ্জ্বল এক ঝাঁক রোদ্দুর। সকাল ৯টা। বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা মালা পরে মিছিলে নেমে পড়েছে রফিক, সামাদ, বরকত, আব্দুল। সহসা গর্জে উঠল শাসকের বন্দুক। আর অমনই লক্ষ বুলেটে বিক্ষত শরীরের ভিতর, তাজা চেতনার ভিতর, লাল রক্তের ভিতর, রুপোলি অশ্রুর ভিতর ঢুকে পড়ল একুশে ফেব্রুয়ারি। জয়ন্তবাবুর গলা বুজে এল। উনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার দুখিনী বর্ণমালা, বাংলাভাষা।’ বলতে বলতে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন জয়ন্তবাবু। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’।
আমেরিকায় চলে আসার আগে জয়ন্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বললেন, ‘দেখ দেখ, দু’চোখ ভরে দেখ পৃথিবীটাকে’! তারপর ওনার কী মনে হল কে জানে হঠাৎ, আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আর যাই কর বাপু, তোর মুখে যেন কোনও দিন এটা না শুনি যে, আই অ্যাম নট সো গুড ইন বেঙ্গলি’! আমি সে দিন জয়ন্তবাবুর দু’চোখে একুশে ফেব্রুয়ারিকে দেখতে পেয়েছিলাম। প্রিয় স্যর, দেড় দশক হল মার্কিন মুলুকে আছি। আপনাকে গর্বের সঙ্গে জানাই, কাগজেকলমে, ই-মেলে, বা কোনও সামাজিক মাধ্যমে, বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যক্তিগত চিঠি বা বার্তা লিখিনি। আপনি আমাকে একুশে ফেব্রুয়ারি শিখিয়েছিলেন। বাংলার জন্য আমার এই হ্যাংলাপনাই আপনার জন্য আমার গুরুদক্ষিণা। গ্রহণ করুন।
মার্কিন প্রবাসী বাঙালি মহলে অবশ্য প্রকৃত বাংলাভাষীরা ভেসে থাকে কিংবা ডুবে থাকে মূলস্রোতের বিপরীতে। ঘ্যানঘ্যানে মার্কা ন্যাকা ন্যাকা ‘বাংলা বাংলা’ বলার অপরাধে তাদের যাবজ্জীবন গণদ্বীপান্তরের সাজা হয়। ‘আমেরিকান বাঙালি সমাজ’-এ নীরদ চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালি’রা বিরাজ করছে সগৌরবে। তারা ‘বাংলার চর্চা নেই বহুদিন’ গোছের একটা কৈফিয়ত দিয়ে, চরম হীনমন্যতার সঙ্গে খসখসিয়ে দু’লাইন ইংরেজি লিখে ইনভাইট করে, মেসেজ পাঠায়, কনগ্র্যাচুলেশন জানায়, হ্যাপি বার্থডে বা হ্যাপি অ্যানিভারসারি বলে, কেউ মারা গেলে আরআইপি লেখে! তারা শুধু বাংলাভাষা ভোলেনি, ‘ভালবাসা’-ও ভুলেছে। তারা একে অপরকে আর ‘তোমাকে ভালবাসি’ বলে না, বলে ‘লাভ ইউ’! সারাক্ষণ গুচ্ছের অ্যাপ নিয়ে তারা খেলে চলেছে! অথচ বাংলা বর্ণমালার অ্যাপ চালাতে গিয়ে ভুল বানান লিখে, অর্থহীন বাক্য ফলিয়ে, ঘেমেচেমে একশা হয়ে যায় ওই বং জেনারেশন। এবং তার জন্য কোনও অনুতাপও নেই ওদের। বাঙালি লজ্জা পায় শুধু ভুল ইংরেজি বললে বা লিখলে। বাঙালি শুধু নির্লজ্জের মতো বলতে জানে যে, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’!
আরও পড়ুন: ভাষা আন্দোলনের আখ্যান বর্ধমানের ভূমিপুত্রের হাতে
আর যাদের ‘বাংলাটা আসে’, তাদের বাংলাটা আবার মার্কিন বাঙালিরা বুঝেও না বোঝার ভান করে, হীনমন্যতার কারণে। ‘বাংলা বোঝা’ মানেই মার্কিনত্ব গেল। বাংলায় হ্যাংলা-রা যদি কখনও ‘স্বামী’ বা ‘স্ত্রী’ বলে, বাংলায় ক্যাবলা-রা তখন চরম রেগে গিয়ে বলে, ‘এই যে খোকা, আঁতলামি ছেড়ে গোদা বাংলায় হাজব্যান্ড বা ওয়াইফ বল তো’! কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না, দেশে-বিদেশে যেখানে যেটুকু সুযোগ পাব, আমি বাংলা বলেই যাব, বাংলা লিখেই যাব। কারণ, আমার ‘বাংলা বুকের ভিতরে’! কারণ, আমি জয়ন্তবাবুর ছাত্র। কারণ, আমি নিজেকে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের সেই সব শিক্ষার্থীর এক জন বলে মনে করি। চ্যাপলিনের সিনেমা দেখতে বসলে, আমি ঋত্বিকের ভাষায় সেটাকে বোঝার চেষ্টা করি। মার্কেজ পড়তে পড়তে আমার মানিককে মনে পরে। বিটলস শুনলে আমার মাথার ভিতরে দৌড় শুরু করে দেয় মহীনের ঘোড়াগুলি। আমি ব্রেখটের নাটক পড়ি, আর ভাবি অজিতেশের কথা। কারণ, বাংলা আমার বচন, আর আমি ‘তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’! আমার মার্কিন মুলুকে বড় হয়ে ওঠা কন্যা লগ্নজিতা ইংরেজিতে কবিতা লিখে নাম করেছে বেশ। ওর প্রেম-প্রকৃতি-প্রতিবাদের কবিতায় আমি ‘বুকের শব্দহীন জোছনার ভিতর’ সেই জীবনানন্দকে দেখতে পাই, খুঁজে পাই সুকান্তের ‘প্রিয়তমাসু’-কে! ওর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসেন রবি ঠাকুর কিংবা সুভাষ বসু। এই তো মাতৃভাষার উত্তরাধিকার। এই তো আমার ‘আ মরি বাংলাভাষা, মোদের গরব মোদের আশা’! এই তো জয়ন্তবাবুর একুশে ফেব্রুয়ারি!
এক বাংলায় ক্যাবলার গপ্পো বলি। লম্বা চওড়া লেজ তার, আইআইটি-কানপুর, আইআইএম-আমদাবাদ, আর তার সঙ্গে কয়েক ছটাক মার্কিন ডিগ্রি। সেই সুবাদে সে মার্কিনদেশের বঙ্গসংস্কৃতি চর্চার স্বঘোষিত হত্তাকত্তা। সে যথারীতি কথায় কথায় ইংরেজি লেখে। তা তাকে শুধোলাম, ‘ব্রুটাস, তুমিও?’ সে জবাব দিল, ‘কথায় কথায় বাংলা লিখলে লোকে বলবে আমি ইংরেজি জানি না।’ বাঙালি সগর্বে বলে, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’। কিন্তু তারা কইতে নারে যে, ‘ইংরেজিটা ঠিক আসে না’! ওই যে, কবি বলেছেন, ‘রেখেছ বাঙ্গালি করে, মানুষ করনি’! প্রতিবাদ করা যাবে না। কারণ বাংলায় ক্যাবলারা তখন বুক ফুলিয়ে বলবে, ‘শুধু বেঙ্গলি করলে চলবে বস, গ্লোবালাইজ হতে হবে তো’! আন্তর্জাতিক! ‘কী ভাবে সাচ্চা আন্তর্জাতিক হইতে হয়’— এই শিরোনামে যদি কোনও পুস্তিকা থাকে এবং সেখানে যদি লেখা থাকে যে, আন্তর্জাতিক হইতে হইলে মাতৃভাষা ভুলিতে হইবে, তা হলে আমি জীবনে ওই এক বার, পৃথিবীর ওই একটিমাত্র বইকে নিজের হাতে পুড়িয়ে দেব’, ব্যঙ্গের সুরে এই কথাটা আমাকে বলেছিলেন হিমুদা। বাংলাদেশের প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। আমেরিকার কোনও এক বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে, এক রোদ-পালানো বিকেলে, এক দার্জিলিং চা-এর আড্ডায়।
আরও পড়ুন: এফএমে সাঁওতালি, রোজই একুশে শিখার
হিমুদা সে দিন আমায় ১৯৯৯ সালের একটি হীরকোজ্জ্বল দিনের কথা বলেছিলেন। ইউনেস্কো-র (ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক, অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন) সদর দফতর প্যারিসে সে দিন একুশে ফেব্রুয়ারি-কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। হিমুদা আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। হিমুদার বর্ণনায়: কী বলব রে ভাই, আমার জীবনের সেরা স্বপ্নের দৃশ্য! রবি ঠাকুরের দু’ দুটো গান বাজল। প্রথমে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। আর তার পরে, যেহেতু ভারতেরও আড়াইটা রাজ্য (অসমকে ধরে) বাংলাভাষী, তাই তাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগনমণ অধিনায়ক জয় হে’। আবিশ্বের কোট-প্যান্ট-টাই পরা সাহেব-মেমরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, বুকের মাঝখানটা ডানহাত দিয়ে স্পর্শ করে, শুনল ওই দুই বাংলা মন্ত্র। আর গানের শেষে সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হল সেই সমুজ্জ্বল কোরাস, ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’। নির্ভুল বাংলা উচ্চারণে!
হিমুদা আর নেই। কিন্তু আমার মধ্যে থেকে গেছে হিমুদার সেই গরবিনী বাংলার উত্তরাধিকার। হিমুদা, এই উত্তরাধিকারটাই তো আমার মাতৃভাষা, আমার বাংলাভাষা। আমার একুশে ফেব্রুয়ারি। আমার কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি হল পঁচিশে বৈশাখের নামান্তর। পঁচিশে বৈশাখ, এক ঈশ্বরের জন্মদিন!