এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিয়োলজি বিভাগের নার্স ছিলেন প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।
গভীর রাতে ফোনে করোনা-আক্রান্ত স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ পান বাটানগরের বাসিন্দা দেবাশিস মণ্ডল। ১২ বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে স্ত্রীর চলে যাওয়ার শোক ভোলার চেষ্টা করবেন, সেই সুযোগও হয়নি তাঁর। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনিও যে আছেন গৃহ-নিভৃতবাসে। মায়ের মৃত্যুতে ছেলে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে সামলাবেন কী করে! তাই সে-কথা ছেলেকে জানাননি। সহধর্মিণীকে শেষ বার দেখতেও যেতে পারেননি।
৩৮ বছর বয়সে এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিয়োলজি বিভাগের নার্স প্রিয়াঙ্কা মণ্ডলের মৃত্যু দেখিয়ে দিল, সংক্রামক রোগ কী ভাবে একটি পরিবারকে অসহায় করে তুলতে পারে। দেবাশিস মঙ্গলবার জানান, ১০ জুলাই তাঁর স্ত্রীর জ্বর আসে। তিন দিনেও জ্বর না-কমায় প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে যান শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। সেখানে লালারসের নমুনা সংগ্রহ করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাতে প্রিয়াঙ্কার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসএসকেএমের নার্সিং কেবিনে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। ১৫ জুলাই হাসপাতালে ভর্তির সময় জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ ছিল। দু’দিন পরে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ১৮ জুলাই ফের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে জানা যায়, রোগিণীর করোনা হয়েছে। প্রিয়াঙ্কাকে পাঠানো হয় বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। সোমবার গভীর রাতে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
দেবাশিস বলেন, ‘‘বাড়িতে ছেলে একা একটা ঘরে রয়েছে। মায়ের মৃত্যসংবাদ জানলে ওকে সামলানো যাবে না। ছেলেকে নিয়ে যেতে কোনও আত্মীয়কে যে অনুরোধ করব, তা-ও সম্ভব নয়।’’ আদতে কাঁথির বাসিন্দা, বেসরকারি সংস্থার কর্মী দেবাশিস জানান, শুক্রবার নমুনা পরীক্ষা করতে যাওয়ার সময় ছেলে তাঁর সঙ্গে ছিল। দীর্ঘদিন মায়ের অনুপস্থিতিতে রাতে বাবার কাছে শুচ্ছিল সে। রবিবার দেবাশিস নিজের সংক্রমণের কথা জানতে পারেন। তবে বাবা বা ছেলের কোনও উপসর্গ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দিন সাতেক পরে ছেলের নমুনা পরীক্ষা করিয়ে তাকে কাঁথির বাড়িতে পাঠানো যাবে।
আরও পড়ুন: মৃত্যু-শীর্ষে উঃ ২৪ পরগনা, মৃতের দেহের নমুনা সংগ্রহ নয়, উঠল প্রশ্ন
দেবাশিসের ভাই ও শ্যালক এ দিন সকালে আইডিতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কার দেহ সৎকারের জন্য অনুমতিপত্রে সই করে এসেছেন। ‘‘শেষ দেখা হল না,’’ কাতরোক্তি দেবাশিসের।
অল্প বয়সে করোনায় নার্সের মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর স্বজনেরা। দেবাশিস জানান, জ্বর আসার দিন তিনেক পরে তিনি জানতে পারেন, ২ জুলাই প্রিয়াঙ্কা এক করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। স্বামীর প্রশ্ন, সংক্রমিতের সংস্পর্শে আসার পরেই প্রিয়াঙ্কাকে নিভৃতবাসে পাঠানো হল না কেন? আইডিতে থাকাকালীন আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে-ক্ষেত্রেও সহযোগিতা মেলেনি বলে অভিযোগ। স্বামীর কথায়, ‘‘আমার স্ত্রীর হাঁপানি ছিল। তবে তার মাত্রা এমন কিছু বেশি ছিল না যে, এই বয়সে মরতে হবে। আর একটু ভাল চিকিৎসা পরিষেবা ওঁর প্রাপ্য ছিল বলে মনে করি।’’
আরও পড়ুন: ‘কী ভাবে টাকা বার করতে হয়, ভাল করে জানি’
মৃতার পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে নার্সেস ইউনিটির সম্পাদিকা ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় জানান, প্রয়োজন অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষা, নিভৃতবাস নীতি মেনে চলা হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, মৃত্যুর পরে সকলেই প্রিয়াঙ্কার কো-মর্বিডিটির কথা বলছেন। তা হলে তো হাঁপানি আছে জেনে রোগীর সংস্পর্শে আসার পরেই তাঁকে নিভৃতবাসে রেখে নজর রাখা উচিত ছিল। সেটা হয়নি কেন? ভাস্বতীদেবীর প্রশ্ন, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনে সংক্রমণের হদিস মেলার পরে সেখানে প্রবেশ-প্রস্থানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা হয়েছে। তা হলে ওয়ার্ডে কারও করোনা হলে সেই ওয়ার্ডকে জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি নার্সদের আইসোলেশনে রেখে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না কেন?’’
এসএসকেএমের নার্সিং সুপার মনীষা ঘোষ বলেন, ‘‘প্রথম দিন থেকেই প্রিয়াঙ্কার সব রকম যত্ন নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব চেষ্টা করেও ফেরানো গেল না।’’ স্বাস্থ্য ভবনের নার্সিং বিভাগের এক কর্তা বলেন, ‘‘সংস্পর্শে এলে সকলকেই নিয়ম মেনে নিভৃতবাসে পাঠানো হচ্ছে। নমুনাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। জুলাইয়ে রোগীর সংস্পর্শে আসার যে-কথা বলা হচ্ছে, তা বোধ হয় ঠিক নয়। যা-ই হোক, এই সব নিয়ে কথা বলার সময় এটা নয়। এত কম বয়সে ওঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।’’