—প্রতীকী ছবি।
এ-ও যেন এক ‘ডাঙ্কি’ মারার চেষ্টা। রাজকুমার হিরানির সাম্প্রতিক ছবিতে পরিবারের অভাব, সংসার চালাতে মায়ের কষ্ট কমাতে একাধিক চরিত্র বেছে নেয় ‘ডাঙ্কি রুট’। ইংল্যান্ডে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঢোকার বিপজ্জনক পথ। অভাবের সংসারে সুরাহা করতে এ রাজ্যের অনেক মেয়েও কিন্তু আঠারোর আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হচ্ছে জীবন বাজি রেখেই।
তেমনই এক জন উত্তর দিনাজপুরের বছর পনেরোর রহিমা খাতুন (নাম পরিবর্তিত)। বাবা মারা গিয়েছেন। মা পরিচারিকার কাজ ও দিনমজুরি করে সংসার চালান। মায়ের কষ্ট কমাতে বিয়েতে রাজি হয়েছিল রহিমা। কিন্তু একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও প্রশাসনের তৎপরতায় তার বিয়ে আটকেছে। রহিমার কথায়, “মা খুব কষ্ট করে সংসার চালান। আমার আরও দুই ভাইবোন রয়েছে। তাই পাশের গ্রাম থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসায় অনিচ্ছা থাকলেও রাজি হয়েছিলাম। কারণ, আমার বিয়ে হলে অন্তত মায়ের সংসারে এক জনের খরচ তো কমবে।”
‘শক্তি বাহিনী’ নামে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রাজ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ঋষি কান্ত বলেন, “প্রশাসনের সহযোগিতায় আমাদের সংগঠনের সদস্যেরা ওই নাবালিকার বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে তার বিয়ে আটকাতে সক্ষম হয়েছেন।” রহিমার মা বলেন, “ওঁরা মেয়ের পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা ও অল্প বয়সে বিয়ের কুফলের কথা বোঝান। মেয়ের ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেব না বলে প্রশাসনকে মুচলেকা দিয়েছি।”
অথচ, এ রাজ্যে ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’র মতো প্রকল্প চালুই হয়েছে কাঁচা বয়সে মেয়েদের বিয়ে আটকাতে। স্কুলে-স্কুলে ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ তৈরি হয়েছে’। তবে নাবালিকা বিয়ের প্রবণতা পুরোপুরি আটকানো যাচ্ছে না। যে সব জেলায় মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার এখনও অনেকটা কম, দেখা যাচ্ছে সেখানেই বাল্যবিবাহ, আঠারোর আগে মা হওয়ার সংখ্যা বেশি। ২০১৯-২০ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস-৫) অনুযায়ী, উত্তর দিনাজপুরে নিরক্ষর মহিলা রয়েছেন ৮৫.৬%। সমীক্ষার সময়ে ২০-২৪ বছর বয়স কিন্তু আঠারোর আগে বিয়ে হয়েছে এমন মেয়েদের সংখ্যা ৪১.৯%। আর আঠারোর আগে মা হয়েছে এমন মহিলার সংখ্যা ১৩.১%।
জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতেও ছবিটা বিশেষ আলাদা নয়। বাঁকুড়ার এক গ্রামের দরিদ্র পরিবারে স্কুল ছাড়িয়ে ১৫ বছরেই বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেজ মেয়েরও বিয়ের তোড়জোড় চলছিল। সে সময়েই শ্বশুরবাড়িতে ‘নির্যাতিত’ হয়ে বড় মেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দিদির মতো পরিণতি যাতে না হয়, তাই এক বন্ধুর হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল মেজো মেয়ে। দুই বোনকে ফের স্কুলে ফিরিয়ে এনেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এ বছর এক সঙ্গে মাধ্যমিকে বসতে চলেছে দুই বোন। তারা বলছে, “স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম।” ওই সংস্থার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ব্রততী দত্ত বলেছেন, ‘‘আমরাও ওই পরিবার ও স্কুলে নজর রাখছি।’’ এনএফএইচএসের সমীক্ষার তথ্য বলছে, বাঁকুড়ায় আঠারোর আগে বিয়ে হয় ৪৫.৭% মেয়ের, আর আঠারোর আগে মা হয় ১৬% মেয়ে। জেলায় নিরক্ষর মহিলা ৬৮.৩%।
২০১৯-২০ সালের সমীক্ষা অনুয়ায়ী, সীমান্তের জেলা নদিয়াতেও নিরক্ষর মহিলা ৭৬.২%, আঠারোর আগে বিয়ে হয় ৩৯.৯% মেয়ের, আর আঠারোর আগে মা হয় ১৫.১% মেয়ে। সম্প্রতি এই জেলায় বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক নাবালিকাকে। চাইল্ড লাইনের এক কর্মীর কথায়, “অনেকে আমন্ত্রিত ছিলেন। আমাদের কথা কেউ শুনতে চাইছিলেন না।” পুলিশের সাহায্যে মাঝরাতে নাবালিকা নববধূকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তার ঠাঁই হয় হোমে। জেলার শিশু নিরাপত্তা আধিকারিক অনিন্দ্য দাস বলছেন, “আগামী দিনেও যাতে কোনও নাবালিকার বিয়ে নাহয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকরা হচ্ছে।”
১২-১৩ বছর বয়সে নিজের বিয়ে আটকে ‘রোল মডেল’ হওয়া পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির ভুরশু গ্রামের মেয়ে বীণা কালিন্দী এখন স্নাতক হয়ে সংসার করছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের লড়াইটাই ছিল অল্প বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে। এত প্রচার আর প্রশাসনের পদক্ষেপের পরেও এখনও বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। তবে সবাই এককাট্টা হলে এই সামাজিক অভিশাপপুরোপুরি মুছবে।’’
(তথ্য: গৌর আচার্য, রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুস্মিত হালদার)