পূজা মাজি
তাঁদের ছোঁয়াটুকুও সামাজিক ভাবে এড়িয়ে যেতে চান অনেকেই। অথচ, প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েটিকে তাঁর স্বপ্ন ছুঁতে তেমন কিছু মানুষই সাহায্য করেছেন।
এইচআইভি-আক্রান্ত এবং এখনও সমাজে ব্রাত্য এই মানুষগুলির সহযোগিতাতেই ডাক্তারি পড়ার জন্য রাজ্যের অন্যতম সেরা মেডিক্যাল কলেজে পা রাখল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের গৌরা গ্রামের পূজা মাজি।
দাসপুর থানার পিছিয়ে পড়া গ্রাম গৌরা। সেখানকার পাঁচবেড়িয়া স্কুলের মেধাবী ছাত্রী পূজা। পরিস্থিতি তাঁকে এমন কঠিন অবস্থায় ফেলেছিল যে, কোনওদিন নিজের আবাল্যলালিত ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন, ভাবেননি তিনি। ঘূণাক্ষরেও প্রত্যাশা করেননি সামাজিক ভাবে কুঁকড়ে থাকা এক দল এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষ নিজেদের যথাসর্বস্ব দিয়ে তাঁকে তাঁর স্বপ্নের কাছে পৌঁছে দেবেন।
আরও খবর: ‘অভিনয়ের সবটাই ধারাবাহিকে খরচ করো না’, দিতিপ্রিয়াকে পরামর্শ প্রসেনজিতের
আরও খবর: দলের ব্যবহারে ‘দুঃখ’ পেলেও তৃণমূল ছেড়ে পালাব না, জানালেন ‘অভিমানী’ সাংসদ প্রসূন
পূজা নিজে বা তাঁর বাড়ির কেউই এইচআইভি আক্রান্ত নন। কিন্তু তাঁদের গ্রামের কয়েকজন প্রতিবেশি এইচআইভি-আক্রান্ত। তাঁদের মাধ্যমেই তাঁর মেধা এবং তার আর্থিক দুরাবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষদের সংগঠন ‘স্পর্শ’ ও তাদের শাখা সংগঠন ‘আশা।’ যে টাকা প্রধানত এইচআইভি-আক্রান্তদের চিকিৎসা, পথ্য, জীবীকানির্বাহের জন্য সংগ্রহিত হয় সেই টাকার একাংশ তারা তুলে দিয়েছিল পূজা-কে। সেই টাকাতেই ডাক্তারি পড়ার জন্য নিটের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন পূজা। এবং দু’বারের চেষ্টায় শেষে ২০২০ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে তিনি এমবিবিএস পড়তে ঢুকেছেন।
পুজা জানান, তাঁর বাবা বিশ্বনাথ মাজি-র ছোট ব্যবসা ছিল। তিনি হঠাৎ মারা যেতে তাঁর মা, দুই দাদা ও তিনি কার্যত জলে পড়ে যান। বাড়িতে পুঁজি কিছু নেই। পরিবারের মাসিক রোজগার ছিল ৪ হাজার টাকা। দুই দাদাও ছাত্র। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন তাঁরা। এই ভাবে লড়াই করেই গোটা ঘাটাল মহকুমায় পূজা মাধ্যমিকে প্রথম হন। ধ্যানজ্ঞান ছিল ডাক্তার হওয়া। কিন্তু তার প্রস্তুতির জন্য বই কেনা বা টিউশন নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। মুষড়ে পড়েছিলেন।
পূজার কথায়, ‘‘একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ার পাশাপাশি নিটের প্রস্তুতি খুব শক্ত। হস্টেলে থাকা, প্রচুর বই-খাতাকলম কেনা এবং বিশেষ একাধিক কোচিং—সবকিছু এইচআইভি-আক্রান্তদের সংগঠনের দেওয়া অর্থেই করেছি। কী ভাবে ওঁদের ধন্যবাদ দেব জানি না। ওই মানুষদের সমাজে সবাই এড়িয়ে যান। অথচ, আমার ক্ষেত্রে ওঁরা না-থাকলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা কখনই লড়তে পারতাম না।’’
দু’বারের চেষ্টায় ২০২০ সালে নিটে পূজা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ৮৩১ র্যাঙ্ক করেন ও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীতে তাঁর র্যাঙ্ক হয় ৬৭। তাঁর অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক ছিল ১৮৩৫৫ এবং সারা ভারতে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীতে তাঁর র্যাঙ্ক ২০৩৭। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান তিনি।
‘স্পর্শ’-র মুখপাত্র রূপালি দাস ও ‘আশা’-র মুখপাত্র মিঠু জানা-র কথায়, ‘‘আমরা ঠিক করেছি, দানের টাকা সংগৃহীত হয় তা আমরা এখন শুধু এইচআইভি-আক্রান্তদের জন্য খরচ করব না। আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্য করব। কারণ, এইচআইভি আক্রান্তদের মতো দরিদ্র মানুষেরাও সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত। তাঁদের পাশে কেউ থাকে না। আর এইচআইভি-র একটা বড় কারণ হল দারিদ্র ও অশিক্ষা।’’
তাঁরা জানান, এই সিদ্ধান্তের জন্যই গ্রামে-গ্রামে তাঁরা এখন দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের খোঁজ করেন, যারা একটু আর্থিক সাহায্য পেলে আকাশ ছোঁয়ার ক্ষমতা রাখে। এই মুহুর্তে এমন ১৩ জন ছাত্রছাত্রী তাঁদের আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে। এই ভাবে সাধারণ মানুষ ও সমাজের সঙ্গে এইচআইভি আক্রান্তেরা সেতুবন্ধও তৈরি করতে চান, যাতে তাঁদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা আর নেতিবাচক মনোভাব ক্রমশ মুছে যায়।