রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই রাজ্য ছেড়েছিলেন নিওনেটোলজিস্ট অরুণ সিংহ। সেই সময় তিনি এসএসকেএমের নিওনেটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। অরুণবাবুর যোগ্যতা নিয়ে সেই সময় প্রশ্নও তুলেছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের কোনও-কোনও কর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং বেতনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রায় ছ’ বছরের ব্যবধানে সেই অরুণ সিংহের তত্ত্বাবধানে তৈরি শিশুদের বুদ্ধি-মেধা বৃদ্ধির প্রকল্প রাজ্যে দ্রুত রূপায়ণের কাজ শুরু করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর! কেন্দ্র এই প্রকল্পের নাম দিয়েছে ‘জার্নি অব দ্য ফার্স্ট থাউজ্যান্ড ডেজ।’ ২০১৩ সালে রাজ্য ছেড়ে অরুণবাবু জাতীয় উপদেষ্টা (রাষ্ট্রীয় শিশু স্বাস্থ্য কার্যক্রম) পদে যোগ দেন। ‘জার্নি অব ফার্স্ট থাউজ্যান্ড ডেজ’ তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত।
মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর বয়স ২ বছর হওয়া পর্যন্ত (গর্ভকালীন ৯ মাস এবং জন্মের পর প্রথম দু’ বছর মিলিয়ে) মোট ১ হাজার দিন হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র বলে, এই সময়ের মধ্যে শিশুর মস্তিষ্কের যাবতীয় বিকাশ হয়। এই বিকাশে সাহায্য করতে এবং শিশুর মেধা ও বুদ্ধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়াতে নির্দেশিকা তৈরি করেছেন অরুণবাবুরা।
চিকিৎসক, নার্স, রোগী সহায়ক, শিশুর মা-বাবা এবং পরিবারের লোককে এই সময়ের মধ্যে কী কী করতে হবে, প্রসূতি কী খাবেন, কী ভাবে থাকবেন, কোন পদ্ধতিতে কখন প্রসব করাতে হবে, শিশুর সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে, সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে নির্দেশিকায়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এটি পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে সমস্ত রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবদের পাঠিয়েছে এবং রূপায়ণ করতে বলেছে।
‘জার্নি অব দ্য ফার্স্ট থাউজ্যান্ড ডেজ’ প্রকল্প
বুদ্ধি-মেধা বৃদ্ধির পন্থা
• অতি জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া প্রসব বেদনা না ওঠা পর্যন্ত প্রসব করানো যাবে না (ওষুধ দিয়ে বা সিজার করে)
• প্রসূতির দাঁতের যত্ন নিতে হবে। তা না হলে শিশুর মানসিক বৃদ্ধি ধাক্কা খায়
• অন্তঃসত্ত্বাকে বকুনি দেওয়া চলবে না
• প্রসবের ঘরে যথাযথ আড়াল ও একান্ত পরিসর থাকতে হবে, ঘরে হাল্কা গান চলবে
• প্রসূতির ঘনিষ্ঠ এক বা দু’জন প্রসবের সময় কাছে থাকবেন
• প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি কাটা যাবে না
*তথ্য: স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পুস্তিকা
কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এই কাজে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাত। সে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এই নির্দেশিকা মেনে রাজকোটের কাছে আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় সরকারি হাসপাতাল দীনদয়াল উপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজে স্ত্রীরোগ বিভাগের পরিকাঠামো গড়ে প্রসূতিদের প্রাক-প্রসব যত্ন ও প্রসব শুরু করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যও এ বার সেই পথে হাঁটতে চলেছে।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এই প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে রাজ্যের মধ্যে প্রথম এই নির্দেশিকা মেনে পরিষেবা শুরু হচ্ছে। একে একে বাকি হাসপাতালে চালু করা হবে।’’ যাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর অভিযোগ এনেছিল, সেই অরুণ সিংহের মস্তিষ্কপ্রসূত প্রকল্পই তো চালু করতে হচ্ছে?
অজয়বাবুর জবাব, ‘‘এটা বিতর্কিত এবং স্পর্শকাতর বিষয়। কোনও মন্তব্য করব না। এই প্রকল্প রূপায়ণ করার নির্দেশ এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে। তা আমরা পালন করছি। অরুণবাবু এখন অনেক বড় দায়িত্বে আছেন। উনি ভাল থাকুন।’’ অরুণবাবুকে রাজ্যে ফেরানোর কোনও চেষ্টা হবে কি না, সে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এমন কোনও পরিকল্পনা এখনও নেই।’’
অতীতে অরুণবাবুর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছিল রাজ্যে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের নজরদারিতে গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি বলেছেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।’’ তবে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত এক বছর যাবৎ এই টাস্ক ফোর্স কার্যত নিষ্ক্রিয়। নিয়মিত এসএনসিউই পরিদর্শন ও টাস্ক ফোর্সের বৈঠকও বন্ধ। আর অরুণবাবুর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছু কারণে সে রাজ্য আমাকে ছাড়তে হয়। আমার বেতনও আর চালু হয়নি। তবে এ নিয়ে কোনও বিতর্ক চাই না। এখন আর আমার কারও উপর রাগ বা দুঃখ নেই। এই নতুন প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের শিশুদের ভাল হলেই আমি খুশি।’’
সেই সঙ্গে অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং আলাদা করে গুজরাতের ভূয়সী প্রশংসা শোনা গিয়েছে অরুণবাবুর মুখে। বলেছেন, ‘‘১০০০ দিনের প্রকল্প তৈরিতে কেন্দ্রের সব রকম সহযোগিতা পেয়েছি। আর গুজরাতিরা দেখলাম, যে কোনও ভাল জিনিসকে বুঝে নিয়ে তা শুরু করে দেওয়ার ব্যাপারে অসম্ভব তুখোড়।’’