ফাইল চিত্র।
চিকিৎসকদের মোবাইলে মঙ্গলবার সকাল থেকেই একটি চিঠি ঘুরছিল। মেয়াদ-উত্তীর্ণ স্টেন্টের ব্যবহার, অস্তিত্বহীন যন্ত্রের ছাড়পত্র-সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজের জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে সেই চিঠিতে অভিযোগ তুলেছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক। এ সব না শুনলে তাঁকে দূরে বদলি অথবা চাকরি ছেড়ে দিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি। অভিযোগের তির সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি নির্মল মাজির দিকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন অভিযোগকারী ওই শিক্ষক-চিকিৎসক।
চিঠিতে রয়েছে, ওই অভিযোগপত্রকে পদত্যাগপত্র হিসাবে গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদ্রোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে ভবানীপ্রসাদবাবু জানিয়েছেন, তিনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে এই পরিস্থিতির চাপ নিতে পারছেন না। তাই ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল এডুকেশন সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিতে চাইছেন।
চিঠিতে ওই চিকিৎসক দাবি করেছেন, হস্তান্তরের নিয়ম না মেনে জোর করেই তাঁকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে মেয়াদ-উত্তীর্ণ ২০২টি স্টেন্ট ব্যবহার হয়েছিল। অডিটে বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও সদুত্তর মেলেনি। এমন অবস্থায় তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবানীপ্রসাদবাবু দাবি করেছেন, চারটি ইকোডপলার যন্ত্র না থাকলেও সে সবের ‘টেকনিক্যাল ফিটনেস সার্টিফিকেট’ দিতে তাঁকে হোটেলে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছিল। হৃদ্রোগী নন, এমন রোগীকে প্রতিনিয়ত বিভাগে ভর্তি করতে চিকিৎসকদের চাপ না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। তা-ও শোনা হয়নি।
বিভাগের কিছু প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসককে সপ্তাহে তিন দিন কয়েক ঘণ্টা করে ডিউটি করানোর চেষ্টাতেও তিনি ব্যর্থ বলে দাবি ভবানীপ্রসাদবাবুর। তাঁর অভিযোগ, ওই চিকিৎসকদের হয়ে ‘প্রক্সি সই’ করেন কয়েক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। বিষয়গুলি স্বাস্থ্য ভবনে জানানোয় গত ২৯ মার্চ রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে নির্মল প্রকাশ্যে তাঁকে অপমান করেছেন বলেও চিঠিতে জানিয়েছেন চিকিৎসক। অভিযোগ, কথা মতো কাজ করতে না পারলে ইস্তফা দিতে বা দূরের জেলায় বদলি করে দেওয়া হবে বলে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন নির্মল।
তাঁর আরও অভিযোগ, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানকে স্থানীয় নির্দেশে ‘এমেরিটাস প্রফেসর’ পদে রাখার জন্যও তাঁকে বলা হচ্ছে। অসুস্থতার কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি বলে উল্লেখ করে চিঠির শেষে ভবানীপ্রসাদবাবুর দাবি, বিভিন্ন দিক থেকে পরোক্ষ ভাবে তাঁকে বলা হচ্ছে, নির্মলের কথায় সায় দিতে হবে, না হলে চাকরি ছাড়তে হবে।
যাবতীয় অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ রঘুনাথ মিশ্র বলছেন, ‘‘এমন চিঠি আমার কাছে আসেনি। ওই চিকিৎসক আমাকেও কিছু বলেননি।’’ নির্মলের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে ফন্দি আঁটা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওঁর সঙ্গে তেমন পরিচয়ই নেই, তাই চাপ দেওয়ারও প্রশ্ন নেই। হাসপাতালের অন্য চিকিৎসকদের মতো ওঁকেও ভাল করে কাজ করতে বলা হয়েছে। হাসপাতাল মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জায়গা। সেটাকে কলতলা বানিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ঠিক নয়।’’
ভবানীপ্রসাদবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে চাননি। ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য সম্পাদক সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যা উন্নয়ন করেছেন, সেখানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে কেন এমন বার বার ঘটছে, আশা করি তা স্বাস্থ্য দফতর দেখবে।’’
বিভিন্ন অভিযোগে শাসকদলের বিধায়ক-চিকিৎসক নির্মলের নাম উঠলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন। গুরুতর অভিযোগগুলি তদন্ত করা উচিত বলে দাবি ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার। ‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজে টসিলিজুমাব থেকে বিভিন্ন কাণ্ডে নির্মলবাবুর নাম জড়িয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধী সাজা পাননি। প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’’