শিবরাত্রির ঢল। ছবি- নিজস্ব চিত্র
কোথাও পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষ, কোথাও বা দীর্ঘলালিত মনোস্কামনা— এ সব নিয়েই আবালবৃদ্ধবনিতার ভক্তি আর বিশ্বাসে ফাগুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালিত হয় শিবরাত্রি।
দোল কিংবা দীপাবলির মতোই সমগ্র ভারতে এটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। শিবরাত্রির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি এবং কিংবদন্তি। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা রীতি রেওয়াজ। কোথাও শিব–পার্বতীর বিয়ে, কোথাও বা নানা উপচার-সহ রুদ্রাভিষেক। এ দিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সারা দিনের উপবাসের শেষে শিবের পুজো করে থাকেন পুণ্য লাভের আশায়। এমনটাই তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
ভূতনাথ মন্দির, নিমতলা শশ্মান
এই শিবরাত্রি নিয়ে শোনা যায় এক প্রচলিত কাহিনি। কাশীতে এক ব্যাধ বাস করত। সারা দিন বনে শিকার করে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরত। এমনই এক বনে গিয়ে সারাদিন অনাহারে ক্লান্ত সেই ব্যাধ একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ব্যাধ বুঝতে পারল সে দিন আর গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই ঠিক করল একটি গাছের উপরে রাত কাটিয়ে পর দিন বাড়ি ফিরবে। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বেলগাছ। ব্যাধ তখন কাছেই একটি বেলগাছের ডালে শিকারগুলিকে বেঁধে রেখে নীচে একটি শক্ত ডালের উপরে বসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথ
সেই বেলগাছের কাছেই একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। গাছের উপরে ব্যাধের নড়াচাড়ার ফলে একটি বেলপাতা সেই শিবলিঙ্গের উপরে গিয়ে পড়ে। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। নিজের অজান্তেই উপবাসী থেকে বেলগাছের একটি পাতা শিবলিঙ্গের উপরে পড়ায় সেই ব্যাধের ব্রত পালন হয়ে গিয়েছিল। পর দিন বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে সে খেতে বসবে, এমন সময় তাঁর বাড়িতে অতিথি এসেছিল। ব্যাধ অতিথি সেবার রীতি মেনে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করল। ফলে নিজের অজান্তে সে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল লাভ করেছিল। বহু বছর পরে ব্যাধের মৃত্যুর সময় এক দিকে যমদূতেরা, অন্য দিকে শিব দূতেরা তাকে নিতে উপস্থিত হল। এই নিয়ে যুদ্ধও বেঁধে গেল। অবশেষে যখন যমদূতরা কৈলাসে শিবের কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই শিবের প্রহরী নন্দী যমদূতদের বলেন, যেহেতু ব্যাধ শিবচতুর্দশীর ব্রত পালন করে পুণ্য অর্জন করেছে তাই তাকে যমদূতেরা নিয়ে যেতে পারেন না। যমদূতরা, যমরাজের কাছে গিয়ে যখন এ কথা জানাল যমরাজ নাকি বলেছিলেন, এই ব্রত যে পালন করবে তার উপর যমের কোনও অধিকার থাকবে না। এই ব্রত মানুষকে সর্ব পাপ থেকে উদ্ধার করে। সেই বিশ্বাস নিয়ে পুণ্যার্জনের আশায় নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে এই ব্রতের পালন করে আসছে।
তারকেশ্বর মন্দিরের বাইরে ভক্তদের ঢল
সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় সিন্ধু সভ্যতার যুগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে লিঙ্গ রূপে শিব পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে বৈদিক যুগে রুদ্রের সঙ্গে তিনি মিলিত হলেন। তবে প্রাক আর্য যুগ থেকেই শিব ঊর্বরতা এবং প্রজননের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য নানা গুণ। শিবের মধ্যে বরাবরই দুটি বৈপরীত্য বার বার ফুটে উঠেছে। এক দিকে তিনি শ্মশানবাসী। ভূত প্রেত তাঁর অনুচর এবং কাপালিক, অঘোড়িরা তাঁর উপাসক। অন্য দিকে সেই শিবই কৈলাসে পার্বতী এবং দুই পুত্র কার্তিক, গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। এ ভাবেই ভোলা মহেশ্বর যেন একেবারে বাঙালির ঘরের লোক হয়ে গিয়েছেন।
কালীঘাট নকুলেশ্বর মন্দিরের দৃশ্য
পরে সুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত যুগের শিল্পে ফুটে উঠেছে শিবের নানা রূপ। এমনকী, বাংলার পাল আমলে যখন বৌদ্ধ ধর্মের এত রমরমা তার মধ্যেও শিবের অস্তিত্ব কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। আবার সেন যুগে যখন শৈব ও শাক্ত ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে তখন লিঙ্গ রূপ ছাড়াও কখনও নৃত্যরত শিব, উমা মহেশ্বর, কখনও বা অঘোড়শিব রূপে তিনি পুজিত হয়েছেন। তবে পরবর্তী সময়ে সুলতানি যুগের শেষে সমাজে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্যের জন্য মূর্তির চেয়ে লিঙ্গ রূপেই শিবপুজোর প্রাধান্য বাড়ে।
ভূকৈলাস মন্দির
কাশীর বিশ্বনাথ, গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে কিংবা নেপালের পশুপতিনাথের মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়। এমনকী, পূজার্চনার ব্যতিক্রমী বিধি দেখা যায়। যেমন ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরে পুজোর শেষে মন্দিরের মহাদীপ স্থাপন এক বিশেষ ঐতিহ্য। মন্দিরের গা বেয়ে এক ভক্ত যখন উঠে চূড়ায় এই মহাদীপ স্থাপন করেন তখন হাজার হাজার মানুষ এই দৃশ্য দেখে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য উপস্থিত থাকেন। তেমনই উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরে এক কালে নানা পবিত্র বস্তু–সহ চিতাভষ্ম দিয়ে মহাদেবের ভষ্মাভিষেক করা হত। এখন তার অন্য বিকল্প ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও হয় বিশেষ শৃঙ্গার। যা দর্শন করতে কয়েক লক্ষ মানুষের আগমন হয়।
আরও পড়ুন- বিল বেশি বা অনিয়ম মানব না, মমতার তোপে সব বেসরকারি হাসপাতাল
অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলার শিবরাত্রির রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। মন্দিরে মন্দিরে চার প্রহরে বিশেষ পূজার্চনার পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় বসে ঐতিহ্যবাহী মেলাও। যদিও মেলার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির, হুগলির তারকেশ্বর, চুঁচুড়ার ষাণ্ডেশ্বরতলা, নৈহাটির বুড়োশিবতলা, আতপুরের জোড়া শিবের মন্দির, হাটখোলার মহম্মদ রমজান লেনে প্রাচীন শিবমন্দির, কালীঘাটের নকুলেশ্বরতলা, কিংবা খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবাড়ির শিবমন্দিরেও সাড়ম্বরে শিবরাত্রি পালিত হয়।
বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির
১৭৮১ নাগাদ রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর প্রাসাদের সামনে শিবগঙ্গা নামে এক দিঘি খনন করান এবং তার উত্তর ও পূর্ব ভাগে দু’টি শিবমন্দির নির্মাণ করে সেখানে রক্তকমলেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৭৮২-তে জয়নারায়ণ প্রাসাদের মধ্যেই পতিতপাবনীর (দুর্গা) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে এক সময় এসেছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। শোনা যায়, তিনি এই অঞ্চলটির নামকরণ করেছিলেন ভূকৈলাস। শিবরাত্রিতে বিশেষ পুজো ছাড়াও মাঝরাতে ১০৮ ঘড়া জলে শিবের অভিষেক ও বিশেষ পুজো হয়। মেলা উপলক্ষে কয়েকটা দিন এখানে বহু মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে।