মমতার সভা, পাহারায় ৯টি জেলার পুলিশ

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে গত তিন বছরে বারে বারেই জঙ্গলমহলে ছুটে এসেছেন মমতা। নিরাপত্তার কড়াকড়ি উপেক্ষা করে ইতিপূর্বে একাধিক বার আম-জনতার মাঝে হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত জানুয়ারিতে বেলপাহাড়ির আমলাশোলে গিয়ে মঞ্চে না-উঠে সরাসরি জনতার ভিড়ে মিশে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেছিলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৭
Share:

ঝাড়গ্রামে পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী।

সাধের জঙ্গলমহলে ফের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে মাওবাদীরা। গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া এমন সর্তকতার জেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝাড়গ্রাম সফরকে ঘিরে অভূতপূর্ব নিরাপত্তার আয়োজন করেছে পুলিশ-প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের পাশাপাশি, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো ৯টি জেলার ৩১৭ জন পুলিশ আধিকারিক-সহ মোট ১,৮৪৪ জন পুলিশ কর্মীকে মোতায়েন করা হয়েছে। সঙ্গে থাকছে আরও দু’হাজার সিভিক ভলান্টিয়ার্স।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে গত তিন বছরে বারে বারেই জঙ্গলমহলে ছুটে এসেছেন মমতা। নিরাপত্তার কড়াকড়ি উপেক্ষা করে ইতিপূর্বে একাধিক বার আম-জনতার মাঝে হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত জানুয়ারিতে বেলপাহাড়ির আমলাশোলে গিয়ে মঞ্চে না-উঠে সরাসরি জনতার ভিড়ে মিশে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেছিলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এতে ‘শঙ্কা’য় পড়তে হয় পুলিশ-প্রশাসনকে। বিশেষত জঙ্গলমহলের মতো এলাকায়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বেলপাহাড়ির আমলাশোল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা থানার চেকাম জঙ্গলে মাওবাদী-যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষে এক বাঙালি কোবরা জওয়ান প্রাণ হারিয়েছিলেন।

ওই ঘটনার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর বেলপাহাড়ির বিভিন্ন এলাকায় মাওবাদীদের ব্যানার-পোস্টার মেলে। ব্যানারগুলিতে মাওবাদীদের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘পিপলস্‌ লিবারেশন গেরিলা আর্মি’ (পিএলজিএ) বা গণমুক্তি গেরিলা ফৌজকে ‘পিপলস্‌ লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ) বা গণমুক্তি ফৌজে পরিণত করার জন্য ব্যাপক ভর্তি অভিযান সংগঠিত করার ডাক দেওয়া হয়। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই জঙ্গল এলাকাগুলিতে তল্লাশি চালাচ্ছে সিআরপি। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, “মাওবাদীদের শক্তিহীন ভাবাটা ভুল। ফলে, মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে এই অভূতপূর্ব নিরাপত্তার আয়োজনটি প্রত্যাশিতই।”

Advertisement

এই আবহে বুধবার সন্ধের মুখে বিকাল ৫টা ৪২ মিনিটে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। রাজবাড়ির সিংহ দরজার কাছে কয়েক মুহূর্তের জন্য থামে মুখ্যমন্ত্রীর সাদা গাড়ি। গাড়িতে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। গাড়িতে বসেই হাত জোড় করে দলের নেতা ও পুলিশ কর্মীদের উদ্দেশে ‘শুভ বিজয়া’ জানান মমতা। এরপর কনভয় নিয়ে রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে যান মুখ্যমন্ত্রী।

ঝাড়গ্রাম সফরে এলে রাজবাড়ির অতিথিশালার ভিআইপি স্যুইটে রাত্রিযাপন করেন মমতা। প্রতিবারই কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে সেখানে। তবে এ বার গোটা রাজবাড়ি ঘিরে ব্যারিকেড-সহ নজিরবিহীন নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে। রাজবাড়ির বাইরে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও একজন ডিএসপি’র নেতৃত্বে ৯৭ জন সশস্ত্র পুলিশ কর্মীকে মোতায়েন করা হয়েছে। আর রাজবাড়ির ভিতরে একজন এএসপি’র নেতৃত্বে ৮৬ জন পুলিশ কর্মী রয়েছেন। লোধাশুলি থেকে যে রাজ্য সড়ক দিয়ে মমতা ঝাড়গ্রামে এসেছেন, সেই জঙ্গলপথে সশস্ত্র পুলিশের দ্বি-স্তরীয় ও ত্রি-স্তরীয় নিরাপত্তা বলয় রয়েছে।

ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে শেষ পর্যায়ের কাজ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

আজ, বৃহস্পতিবার বেলা বারোটা নাগাদ প্রথমে ঝাড়গ্রাম এসপি অফিসের দোতলায় সভাঘরে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া এই তিন জেলার জঙ্গলমহলের পুলিশ ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে উন্নয়ন সংক্রান্ত পর্যালোচনা বৈঠক করার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের সচিবরাও ওই বৈঠকে হাজির থাকতে পারেন বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। প্রশাসন সূত্রের জানা গিয়েছে, মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় কী ভাবে উন্নয়নে ‘আরও গতি’ আনা যায়, সে বিষয়টিই আলোচনায় গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এরপর ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত একটি বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন মমতা। অনুষ্ঠানটি সর্বসাধারণের জন্য নয়। আমন্ত্রিত আড়াই হাজার জন আসবেন ওই সভায়। এ জন্য স্টেডিয়ামের মাঠে বিশাল এলাকা জুড়ে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা-সহ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য হয়েছে অ্যান্টি চেম্বার-সহ ১২০০ বর্গফুটের মূল মঞ্চ। মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী যাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে পারেন, সে জন্য মূলমঞ্চের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ১৪০০ বর্গফুটের একটি নিচু মঞ্চ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আমন্ত্রিতদের বসার জন্য প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুটের প্রশস্ত জায়গা রয়েছে। মূলত, বিভিন্ন পুজো কমিটি, ঈদ কমিটি, ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সদস্যরা রয়েছেন আমন্ত্রিতের তালিকায়। থাকবেন শাসক দলের নেতা ও জন প্রতিনিধিরাও। বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানকে ঘিরেও থাকছে কড়া নিরাপত্তা। স্টেডিয়ামের বাইরে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও তিন জন ডিএসপি’র নেতৃত্বে ১৬৯ জন সশস্ত্র পুলিশ কর্মী থাকবেন। স্টেডিয়ামের ভিতরে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ১৪৪ জন সশস্ত্র পুলিশ কর্মী মোতায়েন থাকবে।

বুধবার দুপুরে ঝাড়গ্রাম এসপি অফিসে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন শীর্ষ পুলিশ কর্তারা। ওই বৈঠকে ছিলেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত, ডিআইজি (মেদিনীপুর রেঞ্জ) বিশাল গর্গ, পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার তথা ঝাড়গ্রামের ভারপ্রাপ্ত এসপি ভারতী ঘোষ প্রমুখ। মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে শীর্ষ পুলিশ কর্তারা অবশ্য প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

তবে এই নিরাপত্তার আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জঙ্গলমহলবাসীর একাংশ। প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গলমহল যদি হাসছে, তা হলে কেন এই পুলিশি বাড়াবাড়ি। কেনই বা, পুলিশের বাছাই করা আমন্ত্রিত লোকজনকে নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী করতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে? বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “জঙ্গলমহলের মানুষ কেমন আছেন, তা জানার আগ্রহ হারিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement